সত্যজিৎ রায়ের মনেই আসেনি তিনি কোনওদিন লেখক হবেন

সত্যজিৎ রায়ের মনেই আসেনি তিনি কোনওদিন লেখক হবেন : ‘সন্দেশ’বের হবার আগে গল্প লেখার প্রয়োজন আছে অথবা গল্প লেখার জন্য সময় দিতে হবে একথাটা সত্যজিৎ রায়ের মনেই আসেনি,তিনি কোনওদিন লেখক হবেন সেটাও তাঁর মাথায় আসেনি৷ যখন তিনি শান্তিনিকেতনে ছাত্র তখন লিখেছিলেন তাঁর প্রথম দুটো গল্প৷ প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘অমৃতবাজার’পত্রিকায় ইংরেজিতে লেখা দুটি গল্পের লেখক হিসেবে তাঁর নাম ছিল ‘এস রায়’৷

সত্যজিৎ রায়ের মনেই আসেনি তিনি কোনওদিন লেখক হবেন
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

সত্যজিৎ রায়ের মনেই আসেনি তিনি কোনওদিন লেখক হবেন

গল্প দুটি লেখার জন্য পত্রিকা কতৃপক্ষ তাঁকে সাম্মানিক দিয়েছিলেন ৫/১০টাকা! এই ঘটনা ১৯৪০সালের৷
অবশ্য লেখক হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের মত বিরাট প্রতিভার বিকাশ একটু বিলম্বেই বোধহয় হয়েছে! তিনি প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচালক,বিরল প্রতিভার মানুষ৷পিতা সুকুমায় রায় যখন মৃত্যুশয্যায়,রবীন্দ্রনাথ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন,শেষবার তিনি এসেছিলেন ১৯২৩সালের ২৯আগস্ট৷সুকুমার রায় কে গান শুনিয়েছিলেন তার মধ্যে কয়েকটি জীবনের আনন্দের গান৷ হয়ত সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিতে সেসব গান আর সুর মনের মধ্যে গাঁথা হয়েছিল,তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনী নিয়ে ছবি করার সময় তিনিও গানে ভরে দিয়েছিলেন৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

ফেলুদা বঙ্গ সংস্কৃতির একটা ক্রেজ, তিনি ফেলুদার স্রষ্টা,ফেলুদা পড়েন নি এমন বাঙালি পাঠক-পাঠিকা খুঁজে পাওয়া মুশকিল,তাদের জন্য’সন্দেশ’পত্রিকায় লেখা সত্যজিৎ রায়ের একটি ছড়া তুলে দিলাম,——

‘এক যে ছিল সাহেব তার যে ছিল নাক৷
দেখতে পরে লাগত লোকের তাক৷
হাঁচতে গিয়ে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ
নাকের মধ্যে লাগল প্যাঁচ৷
সাহেব বলে,এইভাবেতেই থাক’৷

‘সন্দেশ’ ভাদ্র সংখ্যায় ১৩৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ছড়াটি৷
একবার তিনি বলেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রায়ের মহৎ ঐতিহ্য মেনে তিনি কলম ধরেছিলেন৷ ছাত্র অবস্থায় ছিলেন দেশ -বিদেশের গোয়েন্দা গল্পের পোকা৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

‘সন্দেশ’এর পঁচিশ বছর উপলক্ষে চিত্রপরিচালক,অভিনেত্রী অপর্ণা সেন কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন ১৯১৩সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সন্দেশ’,১৩বছর চলার পর সুকুমার রায় প্রয়াত হলে উঠে যায় পত্রিকা৷ ১৯৩১-৩২সালে আবার সন্দেশ শুরু করেন তাঁর কাকা সুবিনয় রায়৷বোধহয় তিনি-চার বছর চলেছিল,তারপর আবার উঠে যায়৷ ১৯৬১সালে সত্যজিৎ রায় নিজেই পত্রিকার হাল ধরলেন নব রূপে ‘সন্দেশের’প্রত্যাবর্তনের নেপথ্যে আছেন আর এক মানুষ৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

শুনুন সেই গল্প প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালকের মুখেই—

‘Not exactly ব্যাপারটা হচ্ছে কি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মাঝে-মাঝে আড্ডা মারতাম রোববার,এই রকম আড্ডা মারতে মারতে সুভাষই বলেছিল,না আমি বলেছিলাম এখন আর মনে নেই—যে ‘সন্দেশটা’ করলে কেমন হয়?Probably সুভাষ ওয়াজ দ্য ওয়ান হু সেড ইট’৷ এসবের ছ’মাসের মধ্যে ‘সন্দেশ’ ছেপে বের হয়ে গেল’৷

প্রথম যখন আরম্ভ হল তখন পত্রিকার দু’জন সম্পাদক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়৷ একটা অফিস ছিল,লোকজন চাকরি করত,সুভাষ মুখোপাধ্যায় অফিস চালাতেন৷ পরে অবশ্য ‘সন্দেশ’ছেড়ে দিলেন কবি,তাঁর জায়গায় এসেছিলেন নিনিদি(নলিনী দাশ)এবং লীলুপিসি(লীলা মজুমদার)৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

ছড়ার সঙ্গে ‘সন্দেশ’পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে ধারাবাহিক বিজ্ঞানভিক্তিক উপন্যাস৷ সত্যজিতের গল্প বলার ভঙ্গি,আমাদের মুগ্ধ করে,তন্ময় করে৷ কাহিনির বুনোট,সহজ,সরল,সরস সমৃদ্ধ ভাষা আর প্রাঞ্জল বর্ণনা এককথায় সুখপাঠ্য৷

মানিক বাবু অপর্ণা সেন কে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে খুব দুঃখ করে বলেছিলেন তাঁরা নিজেরা কেউ পয়সা নেন না,কিন্তু জ্ঞানী মানুষ বিনে পয়সায় কেন সময় দেবে? তাঁরা অনেকদিন contributor দের পয়সা দিতে পারেন নি,সেটা তাঁর একদম ভাল লাগে না৷ তিনি নিজেই বলেছেন ‘সন্দেশ তুলে দাও৷ সন্দেশ তুলে দাও—এরকম ভাবে চলে না’৷ পুজো সংখ্যার আগে সুনীলকে বা শীর্ষেন্দুকে বা অন্য কাউকে বলা ‘আপনারা একটা লেখা দিন’৷ ওরা অবশ্য ভালবেসে দেয় সেটা ঠিকই,কিন্তু আমাদের তরফ থেকে সে পরিমাণে কিছু করার উপায় থাকে না’৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

আসলে সত্যজিৎ বাবু নিজে ঠিক করেছিলেন প্রথমবার তের বছর চলেছিল ‘সন্দেশ’ সুতরাং তাঁরা অন্তত তের বছর চালাবেন ‘সন্দেশ’৷ তার আগে বন্ধ করবেন না,সেটা যে কিভাবে পঁচিশ বছর হয়ে গেল তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেন নি৷

মানিকবাবু অবশ্য নিজের মুখে বলেছেন ‘সন্দেশ’বের হবার আগে গল্প লেখার প্রয়োজন আছে অথবা গল্প লেখার জন্য সময় দিতে হবে একথাটা তাঁর নাকি মনেই আসেনি,তিনি কোনওদিন লেখক হবেন সেটাও তাঁর মাথায় আসেনি৷বহু বইয়ের কাজ করেছেন বই illustration,desighinning ইত্যাদি,প্লাস ফিল্ম,এই দুটো তাঁর কাছে যতেষ্ট মনে হত,কিন্তু এরপরেও কিছু করার দরকার আছে সেটা তিনি অনুভব করেছিলেন ‘সন্দেশ’ সম্পাদনা করার সময়৷
প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন,তবে গোড়ার দিকে লীয়র আর লুইস কারল অনুবাদ করেছিলেন,তারপর গল্প লিখতে আরম্ভ করেন পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ সংখ্যা থেকে৷ বিশেষ ভাবে ঝোঁকটা গিয়েছিল ছোটদের গল্প লেখার দিকে,গোড়ার দিকে লিখেছিলেন ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

এইচ জি ওয়েলস,কোনান ডয়েলস,জুল ভার্ণ এগুলো ভীষণ ভাবে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল,বাংলা পরিবেশে উপাদানগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা তাঁকে বেশ ভাবাত৷

একটা মজার তথ্য তিনি বলেছেন তাঁর অনেক গল্পে একটিমাত্র লোক,সে বিয়ে করেনি,তাঁর ছেলেপিলে নেই,একা থাকে,যেমন অসমঞ্জবাবু,বঙ্কুবাবু৷ সত্যি বলতে কি ছোট গল্প লেখার আগে মানিকবাবু কোনওদিন নোট লিখে রাখার ধার ধারতেন না,ছোট গল্প তিনি একদিনেই লিখে ফেলতেন,ফেলুদা লিখেছিলেন মাত্র দশ দিনে,চিত্রনাট্য লিখতেন দশ বড় জোর পনের দিনে৷এমন উদাহরণ আছে ‘সন্দেশ’এর জন্য রূপকথা লিখেছেন তিনটি,’আনন্দমেলার’জন্য একটি,অথচ চারটি গল্প তিনি লিখে ফেলেছেন মাত্র দু’সপ্তাহে৷

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

সত্যজিৎ রায় নিজের মুখে একবার বলেছিলেন ‘প্রতিভা সর্বকালে সর্বদেশে বিরল’৷ মজার বিষয় তিনি নিজেই সেই বিরল প্রতিভার মানুষ৷ সাক্ষাৎকারের এক পর্বে অপর্ণা সেনের প্রশ্ন ছিল

‘কাপুরুষ’,’মহানগর’এর মেয়েরা খুব শক্তিশালী,এবং ‘সীমাবদ্ধ’র মেয়েটিও প্রায় বিবেকের কাজ করে?উত্তরে মানিকবাবু বলেছিলেন— ‘মেয়েদের সন্বন্ধে আমার বোধহয় একটা subconcious conviction আছে যে তারা বেসিক্যালি বেশি সৎ বেশি forfhright,তারা শারীরিক ভাবে পুরুষদের চেয়ে দুর্বল বলেই কতকগুলো compensating factot যেগুলো তাদের সে দুর্বলতাটা অন্যদিক থেকে পূরণ করে দেয় সেটা তাদের চরিত্রের মধ্যে আছে বলে আমার মনে হয়’৷কথাগুলি সত্যিই প্রনিধানযোগ্য,এই বিষয়ে সন্দেহের মনে হয় অবকাশ নেই!আপনারা কি বলেন!

Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي
Satyajit Ray, সত্যজিৎ রায়, ستیہ جیت رے ,सत्यजीत रे, ساتياجيت راي

 

সংকলনে—অরুণাভ সেন৷

#সত্যজিৎরায়
#কিংবদন্তিচিত্রপরিচালক
#সন্দেশপত্রিকা
গ্রন্থঋণ,চিত্রঋণ সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎকার সমগ্র,
সম্পাদক সন্দীপ রায়

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment