স্লামডগ মিলিয়নেয়ার 

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ স্লামডগ মিলিয়নেয়ার  ।

স্লামডগ মিলিয়নেয়ার

 

স্লামডগ মিলিয়নেয়ার 

 

স্লামডগ মিলিয়নেয়ার

চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ :

জীবনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সঠিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার এক বস্তির ছেলের গল্প।

দেশ                          : ব্রিটেন

পরিচালক                 : ড্যানি বয়েল

                                   লাভলিন ট্যান্ডন (সহ-পরিচালক)

লেখক                       :সিমন বিউফয়

                                   বিকাশ স্বরূপের উপন্যাস

রিলিজ ডেট              : ২৩ জানুয়ারি ২০০৯

মুখ্য চরিত্র                 :দেব পাটেল, সৌরভ সুকলা, অনিল কাপুর ফ্রিদা পিনটো, ইরফান খান

                                   আজহার উদ্দীন মোঃ ইসমাইল, আইউশ মহেশ

 

স্লামডগ মিলিয়নেয়ার

বাংলাদেশের পাঠক-পাঠিকা মুন্সী প্রেমচাদের সাহিত্যের সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। কথাসাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচাদের ছোট গল্প ‘বড়দা’-এর বড় ভাই ছোট ভাইকে গাইড করতে যেয়ে একটা চমৎকার কথা বলে।

বড় ভাই ছোট ভাইকে বলে, ‘ভাই, ভাই আমার। বোধ শুধু বই পড়লে হয় না। দুনিয়া দেখলে হয়। আমাদের মা কোনো ক্লাস পাস করেন নাই। দাদুও বোধ হয় পাঁচ কি ছয় ক্লাসের বেশি এগুতে পারেন নাই। কিন্তু আমরা যদি স্কুল কলেজের সব পড়া শিখেও ফেলি তবু শিখাবার এবং শোধরাবার অধিকার তাদের থাকবে।

তারা হয়তো আকাশে কত নক্ষত্র, আমেরিকার শাসনব্যবস্থা ঠিক কিরকম কিংবা অষ্টম হেনরী কতবার বিয়ে করেছেন সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো জানে না কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে হাজার হাজার প্রশ্নের উত্তর তারা জানবে চিরকাল।

একাডেমিক শিক্ষা বড় না জীবনবোধের শিক্ষা বড় সে নিয়ে বছরের পর বছর তর্ক চললেও জীবনের কোনো শিক্ষাই যে বিফলে যায় না সে কথাই বার বার মনে হচ্ছিল হলভর্তি দর্শকের সাথে বসে এবারের আট ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কার পাওয়া যৌথ পরিচালক ড্যানি বয়েল এবং লাভলিন ট্যান্ডন-এর চলচ্চিত্র ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’ দেখতে দেখতে।

বিকাশ স্বরূপ-এর মূল উপন্যাস ‘কিউ অ্যান্ড এ’ অবলম্বনে একটি বস্তির সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে থেকে কিভাবে একটি ছেলে তার বেড়ে ওঠা জীবনের জ্ঞানকে পুঁজি করে আট-দশটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দুরাতের মধ্যে হয়ে উঠল দুই কোটি রুপির মালিক এবং সমগ্র ভারতবাসীর নয়নতারা সেই প্রেক্ষাপট নিয়েই চলচ্চিত্র স্লামডগ মিলিয়নেয়ার।

মিলিয়নেয়ার হওয়া তো দূরের কথা চলচ্চিত্রের শুরুতেই জামাল মালিক (দেব প্যাটেল)-কে পিটিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে থানার কনস্টেবল। জামালের অপরাধ সে সামান্য এক বস্তির ছেলে হয়ে, ন্যূনতম লেখাপড়া না জেনে, ভারতের সেরা টিভি শো ‘কে হতে চায় কৌড়পতি’র হট সিটে বসে জটিল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে এক কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।

যদি আগামী কাল পর্যন্ত বেঁচেবর্তে থাকে তবে সমূহ সম্ভাবনা আগামী দিনের শেষ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হয়ে যাবে দুই কোটি রুপির মালিক। অশিক্ষিত অজ্ঞ একটি ছেলে কিভাবে প্রশ্নের উত্তর টপাটপ দিয়ে গেল সেই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এই স্পেশাল পুলিশের ঠ্যাঙানি।

কনস্টেবল রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হলে পুলিশ অফিসার (ইরফান খান) নিজে এসে ইলেকট্রিক শক দিয়ে শুরু করে জেরা পর্ব। থানার মধ্যেই প্রচারিত হয়ে যাওয়া ‘কে হতে চায় কৌড়পতি’ ভিডিও ফুটেজ চালিয়ে চলতে থাকে রহস্য উদ্ঘাটনের পরিক্রমা।।

পরিক্রমার চলমান পথে শৈশবেই যে সরাসরি স্বপ্নের অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের কাছ থেকে পেয়েছিল অটোগ্রাফ এবং সেই অমিতাভই যে জঞ্জির চলচ্চিত্রের সুপারস্টার নায়ক এটা জামাল মালিকের ছোটবেলা থেকেই জানা।

ফলে প্রথম প্রশ্ন ১৯৭৩ সালে সুপারহিট চলচ্চিত্র জভির নায়কের নাম কি তার উত্তর দিতে মুহূর্ত বিলম্ব হয়নি। ভারতের অশোকস্তম্ভের নিচে কি লেখা সে উত্তর জানা না থাকায় দর্শকদের ভোটের অপশনে সঠিক উত্তর দিতে পারে জামাল মালিক।।

শ্রীরামচন্দ্রের ডান হাতে সব সময় কি ধরা থাকতো প্রশ্নে মনে পড়ে ভয়াবহ দাঙ্গার কথা। দাঙ্গা-হাঙ্গামার মধ্য শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তি দেখা এবং সেই সূত্রে বলতে পারা, শ্রীরামচন্দ্রের হাতে থাকতো তীর-ধনুক। সংকটে বিপদে আত্মরক্ষার্থে এই অস্ত্রধারণ।

ধারণক্ষমতার বাইরে ততক্ষণে জামাল মালিক জিতে গেছে ষোল হাজার রুপি। এত অর্থ একসাথে বস্তিজীবনে জামাল মালিকের দর্শন করার সুযোগ না হলেও ‘দর্শন দাও গণশ্যাম…’ গানটির রচয়িতা কবির নাম কি প্রশ্নে মনে পড়ে ভিখারী সিন্ডিকেট দালালদের কথা।

বস্তির বাচ্চাদের আশ্রয় দেয়ার নাম করে কিভাবে ছোট ছোট শিশুকে অন্ধ বানানো হয়, বাচ্চা মেয়েদের দেহপসারিণী করে তোলা হয় সে কথা যেমন মনে পড়ে তেমনি মনে পড়ে। দালালদের নেতার প্রিয়ভজন ‘দর্শন দাত গণশ্যাম’ গানটির কথা।

দালালের মুখ দিয়েই জামাল মালিক একদিন শুনেছিল তার প্রিয় ভজনটির কবির নাম কবি সুরদাস। সঠিক উত্তর দিতে পারায় তখন জামাল মালিক আড়াই লক্ষ রুপির মালিক। হটসিটের উপস্থাপক (অনিল কাপুর) যে বস্তির ছেলে জামাল মালিকের হটসিটে বসতে পারা নিয়ে শুরু থেকে তাচ্ছিল্যের সাথে কলসেন্টারের চাওয়ালা, মালাইওয়ালা বলে তৃপ্তি পাচ্ছিল সেই উপস্থাপক জামাল মালিকের টপাটপ উত্তর দিতে পারায় যারপর নাই বিরক্ত।

বারংবার অর্জিত অর্থ দিয়ে জামাল মালিককে ফেরত যাওয়ার ইঙ্গিত করলেও জামাল মালিক অনড় সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। ফলে দশ লক্ষ রুপির প্রশ্ন, একশো ডলারের উপর ছাপা মানুষটির নাম কি? জামাল মালিকের যে বন্ধুটি দালালদের খপ্পরে পরে অন্ধ হয়ে গান গেয়ে পথে পথে ভিক্ষা করছে সেই জানিয়েছিল একশো ডলারের উপরের ছাপা ছবি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ফলাফলে দশ লক্ষ জয়।

 

স্লামডগ মিলিয়নেয়ার 

 

রিভলভারের আবিষ্কারক কে সে প্রসঙ্গে মনে পড়ে জামাল মালিকের বড় ভাই সেলিম যেদিন প্রথম নেতাকে গুলি করে মারে সেই রিভলভার সূত্রে জানা রিভলভারের আবিষ্কারক স্যামুয়েল কষ্ট। ব্রিটেনের কোন শহরে ক্যামব্রিজ সার্কাস অবস্থিত সে প্রশ্নের উত্তর জামাল মালিক খুঁজে পায় কল সেন্টারে কাজ করার সুবাদে।

কল সেন্টারের সুবাদেই এই টিভি শো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া এবং ক্যামব্রিজ সার্কাস যে লন্ডনে অবস্থিত সেটা বলতে পারা। এরপর কোটি রুপির প্রশ্নের পূর্বে ছোট ব্রেক। একরকম প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উপস্থাপক বলে জামাল মালিককে ফেরত যেতে। বাথরুমে জামাল মালিক যাওয়ার আগে উপস্থাপক লিখে আসে বড় করে জামাল মালিকও সেটা পড়ে।

কোটি রুপির প্রশ্ন, কোন ক্রিকেটার সব থেকে বেশি সেঞ্চুরি করেছে। চারটি উত্তরের মধ্যে শচিন। টেন্ডুলকারের নাম প্রথমে বললেও পরে ফিফটি ফিফটি অপশনের সুযোগ নেয়। তাতে শচিন, মাইকেল স্লেটর বাদ যায়। অবশিষ্ট রিকি পন্টিং এবং জ্যাক হবস।

যথাক্রমে নাম্বারিং-এ B এবং D। উপস্থাপকের ইন্টারেস্ট B- এর দিকে। বাথরুমে লেখাও B। জামাল মালিকের মনে হয় যে উপস্থাপক তার ভালোই চাচ্ছে না সে কেন সঠিক উত্তর জানাবে। ফলে উত্তর D অর্থাৎ জ্যাক হবস্ ।

সঠিক উত্তরও D। ফলে জামাল মালিক কোটিপতি। শো-এর সময় শেষ হলে শেষ প্রশ্ন আগামীকালের শোতে হবে বলে অনুষ্ঠান সেদিনের মত শেষ হয়। রাগে, হিংসায় উপস্থাপক চিট করার অভিযোগ করে জামাল মালিককে জোর করে তুলে দেয় থানার পুলিশের কাছে। যে কারণে এখন চলছে জেরা পর্ব।

সবকিছু শুনে পুলিশ অফিসার পরের শোতে জামাল মালিককে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। অপরদিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে যোগ দেয়া বড় ভাই সেলিম, যে কিনা জামালের ভালোবাসা লতিকাকে এতদিন অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছিল সে লতিকাকে মুক্ত করে দেয়।

শো-এর শেষ প্রশ্ন আলেকজান্ডার দুমোর তিন মুসাফির বই-এর দুই মুসাফিরের নাম অথস ও পথস, তৃতীয় মুসাফিরের নাম কি? জামাল মালিক লাইভ ফোনে সহযোগিতা চায় তার বড় ভাই সেলিমের কাছে। কিন্তু সেলিম মুক্ত লতিকাকে মোবাইল সেটটাও দিয়ে দেয়।

ফোনে কথা বলে পতিকা। শৈশবের ভালোবাসাকে ফোনের অপরপ্রান্তে পেয়ে জামাল মালিক বিস্মিত। তাহলে শেষ পর্যন্ত তার ভালোবাসাকে সে ফিরে পেল। অপরদিকে টিভি প্রোগ্রাম দেখে মুক্ত লতিকার: কথা জেনে বড়ভাই সেলিমকে ভাট করতে এগোয় গ্যাংলিডার।

উত্তর জানা না থাকলেও A to D-এর হেড A-কেই বেছে নেয় জামাল মালিক। ফলাফল একদিকে গুলি ছুঁড়তে চূড়াতে অর্থের তলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো বড় ভাই সেলিম আর সঠিক উত্তর দিতে পেরে দুই কোটি রুপির পুরস্কার তুলে নিল। জামাল মালিক।

একই বস্তির, একই মায়ের দুই সন্তানের দুই পরিণতি। একদিকে লোভ, অন্যদিকে ব্যাকুলতা। একটা তিরস্কার অন্যটি পুরস্কার। পরিচালক ড্যানি বয়েল যেন বোঝাতে চাইলো একই মাটির উর্বরতায় আগাছা আগাছাই হয় আর গাছ ফলবান হয়ে ওঠে।

 

স্লামডগ মিলিয়নেয়ার 

 

লোভ আর কামনায় বড়ভাই সেলিম যা ধরে রাখতে পারেনি, ব্যাকুলতা, প্রেম আর সততা দিয়ে জামাল মালিক ভাই পেল। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ লতিকাকে তাই জামাল মালিক বলতে পারলো, ইউ আর মাই ডেস্টিনি (তুমিই আমার গন্তব্য)। ব্যাকগ্রাউন্ডে এ. আর. রহমানের জোরালে কন্ঠস্বর জয় হো, জয় হো… ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment