আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ সিনেমা প্যারাডিসো ।
সিনেমা প্যারাডিসো
সিনেমা প্যারাডিসো
চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ :
ইতালীর এক চলচ্চিত্র পরিচালক এর পরিচালক হয়ে উঠবার পথপরিক্রমা এবং এক প্রজেকশনিস্টের কাহিনী।
দেশ : ইতালি
পরিচালক : গিসুপি টরনেটরি
লেখক : গিসুপি টরনেটরি
রিলিজ ডেট : ১৯৮৮
মুখ্য চরিত্র : সালভেতর ক্যাসিকো
ফিলিপ নয়রেত
মারকো লিওনার্দি
জ্যাকিউয়েস পেরিন
সিনেমা প্যারাডিসো
কত দিনের পর দিন রাতের পর রাত অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বসে একেকজন প্রজেক্টশনিস্ট যেভাবে সেলুলয়েডের ফিতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শত শত দর্শকের সামনের পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন কত রং-বেরঙের চলচ্চিত্র সেসব প্রজেক্টশনিস্টের জীবনের সুখ-দুঃখ বিরহ-মিলন ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে একটা চলচ্চিত্র নির্মিত হলে সেটা কেমন হতো ভেবে ভেবে যখন কল খুঁজে পাওয়া গেল না তখনই দেখার সুযোগ হলো ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ফিলা ক্লাবের আয়োজনে জার্মান কালচারাল সেন্টারের অডিটরিয়ামে ইতালির বিখ্যাত চলচ্চিত্র, অস্কার ক্যাটাগরিতে বিদেশী চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র “সিনেমা প্যারাডিসো’।
সমসাময়িক সময়টাক ভালোভাবে বুঝে সবার সাথে শেয়ার করা, ভিন্ন সংস্কৃতিকে জানা বোঝা, একটা সঠিক বক্তব্যকে কোটি কোটি দর্শকের সামনে উপস্থাপনার স্বার্থে মিডিয়া হিসেবে চলচ্চিত্রকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার যে দীপ্ত প্রত্যয় নিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ক্লাবের গড়ে ওঠা তারই পথপরিক্রমায় নোম্যানসল্যান্ডের পর সিনেমা প্যারাডিসো।
একজন চলচ্চিত্রকার কিভাবে ইতালির এক অখ্যাত গ্রাম থেকে ভুবনবিখ্যাত চলচ্চিত্রকারে রূপান্তরিত হলেন, বিখ্যাত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একজন প্রজেক্টশনিস্ট কিভাবে প্রেরণা জোগালেন, চলচ্চিত্রের গতিপথটা কিভাবে প্রজেক্টশনিস্টের চোখের সামনে দিয়ে দিনে দিনে বদলে গেল, দাহ্য সেলুলয়েড কিভাবে সময়ে সময়ে পুড়িয়ে দিল জীবনের খণ্ডিত অংশ, বিরহহীন জীবন কত যন্ত্রণার এরকম নানান ঘটনার সন্নিবেশে ইতালির পরিচালক গি সুপি টরনেটরির চলচ্চিত্র সিনেমা প্যারাডিসো।
প্যারাডিসো মানে যে প্যারাডাইস না সেটা বোঝা গেল চলচ্চিত্রের শুরুতে টেলিফোনে মৃত্যুর খবর পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আমি চিত্রপরিচালক সালভেতর ডি ভিটার মা সিগনোর মারিয়া কথা বলছি ইতালির গিয়ান্স এন্ডো থেকে।
সে রোমে গেছে না না করেও ত্রিশ বছর পার হলো। আপনি তাকে বলবেন আজ তার বাড়ি ফেরাটা জরুরি এবং আমরা সবাই তার জন্য অপেক্ষায় আছি কারণ তার বৃদ্ধ বন্ধ আলফ্রেডো আজ প্রভাতে শেষবারের মতো নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
জায়গা ত্যাগ করলেও মন থেকে যে জায়গা, আপনজন, আত্মীয় বন্ধু বাছব ত্যাগ হয় না সেটা বাড়ি ফেরা মাত্র সালভেতর ডি ভিটাকে দেখলে বোঝা যায়। দুঃসংবাদটা শোনার পর বিছানায় শায়িত সালভেতর স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে তার জীবনের প্রথম আবিষ্কার সেরা মানুষ প্রজেক্টশনিস্ট আলফ্রেডো।
বাংলাদেশের হলের নাম যেমন চিত্রালি কিংবা রূপালী তেমনি ইতালির গিয়ান্স এন্ডো মফস্বল শহরের হলটির নাম প্যারাডিসো। সেই হলেই সাদা-কালো চলচ্চিত্র দেখতে এসে আলফ্রেডোকে প্রথম দেখে সালভেতর। আচ্ছা, পর্দায় যে মানুষগুলো হাঁটাচলা করে সেই মানুষগুলো কি পর্দার পিছনে, কৈ পর্দার পিছনে নেই তো। তবে আলোকরশ্মি আসছে যে ঐ চিলেকোঠার থেকে মানুষগুলো কি তবে সেই চিলেকোঠায়।
শিশুসুলভ বুদ্ধি নিয়ে সালভেতর খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যায় ঐ চিলেকোঠায় সেখানে সেলুলয়েডের ক্যান থেকে সেলুলয়েডের ফিতা বের করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রদর্শিত হচ্ছে চলচ্চিত্র। শিশু সালভেতর মরিয়া কলাকৌশল রপ্ত করতে। কিন্তু আলফ্রেডোর কড়া নির্দেশ অপ্রাপ্ত বয়স্কদের এ কাজ শেখা নিষেধ।
বিধি-নিষেধের আইন প্রণয়নের দায়িত্বে তখন ক্যাথলিক চার্চ। চার্চের ফাদার বিশ্বাস করেন বিনোদন এবং শিক্ষার প্রসারে চলচ্চিত্রের বিকল্প নেই। কিন্তু শিশু, যুবা, বুদ্ধ, কন্যা, যুবতী, মাতা একসাথে বসে যা দেখবে সেখানে অবাঞ্ছিত দৃশ্য অর্থাৎ খোলামেলা পোশাক কিংবা চুম্বন দৃশ্য না থাকাই ভালো।
ফাদার প্রথমে চলচ্চিত্র দেখে বাদ দেয়ার মতো দৃশ্য মার্ক করেন, আলফ্রেডো সেলুলয়েডের সেই অংশ কেটে বাদ দেন আর বাদ অংশ যেহেতু বাদ সেই নন-সেন্সরড সেলুলয়েডের অংশটুকু হাতে করে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য শিশু সালভেতর বায়না ধরে। যা বয়স্কদের জন্য তা কি হাতে করে শিশুদের তুলে দেয়া যায়? যায় না বলেই আলফ্রেডো বলে, এগুলো তোমার কিন্তু আমার কাছে জমা থাকবে। যখন তোমার সময় হবে তখন তোমায় দেবো।
দেবো ফেরত দেবো, যে অর্থ তুই ভাঙিয়ে সিনেমা দেখেছিস তা তো খরচ করেই ফেলেছিস তা আর তুই কোথা থেকে ফেরত দিবিরে বেয়াদপ টোটো। তুই কি জানিস তোর বাবা তখন যুদ্ধক্ষেত্রে, আমি কিভাবে সংসার চালাই সে এক আকাশের ঈশ্বর জানে আর এই আমি, আমি তোর মা জানি।
ঘরে তোর ছোট বোনের জন্য পঞ্চাশটা টাকা রেখেছিলাম। সেই পঞ্চাশটা টাকা ভাঙিয়ে তুই বোনের দুধ না কিনে সিনেমা দেখেছিস। ঐ সিনেমায় তুই কি পাস। সিনেমা কি তোরে দুপুরের ভাত দেবে না রাতের রুটি দেবে। বল, পঞ্চাশ টাকার কত টাকা তুই সিনেমা দেখে উড়িয়েছিস। সত্যি করে বল। না মা, তুমি বিশ্বাস করো আমি একটি টাকাও ব্যয় করিনি।
টিকিট কেটে সিনেমা দেখিনি। যদি টিকিট না কাটবি তবে টাকা গেল কই। টাকার কি বকের মতো দুজোড়া ডানা আছে যে পকেট থেকে উড়াল দিল। চিত্রপরিচালক সালভেতর, শিশু নাম টোটো, করুণ করে বলে, মা পকেট থেকেই টাকাটা হারিয়ে গেছে। কথায় কাজে অমিল পেয়ে শিশু টোটোকে যখন মা সিগনোর মারিয়া মারছে তখন আর আলফ্রেডো চুপ করে থাকতে পারে না।
আলফ্রেডো টোটোর মাকে বলে, ইতালির সরকার তো শিশুদের জন্য বিনামূল্যে সিনেমা দেখার সুযোগ দেয়। নিশ্চয় ওর পকেটের পঞ্চাশটা টাকা অন্য কোনোভাবে হারিয়ে থাকতে পারে। হয়তো সিনেমা দেখতে দেখতে পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে। আচ্ছা দাঁড়ান, সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। সহকর্মীর কুড়িয়ে পাওয়ার অর্থ ফেরত দেয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালক গিসুপি টরনেটরির তিনটি ক্লোজ শট দর্শকদের মাঝে নানা অনুভূতি পৌঁছে দেয়।
মা সিগনোর মারিয়ার মুখের ক্লোজ শটে বোঝা যায়, বাবা টোটো, তুমি বিশ্বাস করো আমার মাথামুণ্ডুর কিছুই ঠিক নেই । তোমার বাবা যুদ্ধ পছন্দ করে না তবু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে। এতদিনে নিশ্চয় তিনি বেঁচে নেয়। যে মানুষ যুদ্ধ পছন্দ করে না তাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হলো। নাগরিক হিসেবে প্রতিদিনই আমার রাগ জনো।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি ক্রোধে আমি অন্ধ হয়ে যাই। মুসোলিনির ডিক্টেটরশিল্প অসহনীয়। তবু সইতে বাধ্য হই। এই যে প্রতি মুহূর্তের রাগ তা কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পেতে চায়। হয়তো সেরকম কোনো একভাবের বহিঃপ্রকাশে আমি তোমার গায় হাত তুলি। উপরন্তু ব্যাধিস্বরূপ দরিদ্রতা।
রোগ, ঋণ আর দরিদ্রতা যার ঘরে সে ঘরে সুখ-শান্তি দূর অস্ত। ফলে রাগ প্রকাশের একটি মাত্র আপন জায়গা বাবা টোটো তুমি। তোমাকে যদি হাজারও মারি তবু জানি তুমি তোমার মাকে ফেলে যাবে না। আবার এও ভাবি তোমায় যদি পাঁচটা চড় মারি তবে তা পঞ্চাশটা শেল হয়ে আমার বুকে আঘাত করে। তবুও বাবা ক্রোধে যে আমি কি করতে কি করি আমার নিজেরই ঠিক থাকে না।
বাবা টোটো তুমি তো ছোট শিশুমাত্র তোমার এত কিছু বোঝার কথা না। মার উপর রাগ কর না, বাড়ি চল বাবা টোটো, বাড়ি চল। আলফ্রেডোর মুখের ক্লোজ শটে পরিচালক যেন দেখালেন, শৈশবের দশ বছর বয়স থেকে আজ এই ষাট বছর ছুঁয়ে বৃদ্ধ হতে যাচ্ছি কিন্তু সিনেমাপ্রেমী টোটোর মতো এরকম শিশু তো এর আগে দেখিনি।
বার বার আমার ঘরে যেয়ে নষ্ট সেলুলয়েডের ফিতা চাইলে আমি তাকে গালমন্দ করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। দুপুরের খাবার বয়ে আনা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে খাবার বয়ে এনে নানাভাবে আমার মন সন্তুষ্ট করার চেষ্টাটাকে আমি শুধু শিশুর কৌতূহল মাত্র ভেবেছি। অথচ যে শিশু সিনেমা দেখার জন্য মায়ের হাতে মার খাওয়ার অসহ্য যন্ত্রণাও শান্তভাবে মেনে নেয় সেই শিশু টোটোর মনের সিনেমার প্রতি ব্যাকুলতাটা ধরতে পারলাম না।
বের করে দিলাম। না আর না। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই আমি এই শিশুকে আমার অভিজ্ঞতায় যা কিছু আছে তা উজাড় করে দেবো। এই শিশু টোটো একদিন মস্ত বড় চলচ্চিত্রকার হবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর টোটের মুখের ক্লোজ শটের একটাই ভাষা আর সেটি হলো, মি. আলফ্রেডো, আমি বুঝে গেছি আপনি আজ থেকে আমায় ভালোবেসে ফেলেছেন, আমি টোটো আপনার মনের মধ্যে।
আপনার মনের মধ্যে ঢুকতে পারার অর্থ চলচ্চিত্র প্রজেকশনের আগাগোড়া সবই জেনে যাওয়া। এত সুযোগ আসার জন্য মায়ের হাতের পাঁচটি চড় কি যদি দুই হাতে পাঁচটা পাঁচটা দশটা বেত মারাও হয় তবু তা সহ্য করা আমার জন্য নস্যি। শিশু টোটোর চরিত্রে সালভেতর ক্যাসকিওর অভিনয় ভোলার নয়।
ভোলার না হলেও ভুল হয়ে যায় টোটোর। যৎসামান্য সেলুলয়েডের ফিতা আর পোস্টকার্ডে মা-বাবার একসাথে তোলা ছবি পরম মমতায় ক্যাশবাক্সে ভরে বিছানার পাশে মাথার বালিশের কাছে রেখে দেয় টোটো। স্কুল থেকে ফিরেই দেখে এসিডেট সেলুলয়েড বাতাসের স্পর্শে আপনা আপনি জ্বলে ঘরে আগুন ধরে গেছে। মা একক চেষ্টায় আগুন নেভাতে পারলেও ততক্ষণে বেশ খানিকটা পা পুড়ে গেছে ছোট বোনের।
বাবা-মায়ের একসাথে তোলা ছবি অনেকটা পুড়ে গেলেও বাবা এবং মায়ের মুখটা অক্ষত। বাবা- মায়ের ছবি বুকে জড়িয়ে টোটো কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা মাগো, বাবা যে আর কোনোদিনই বাড়ি ফিরবে না। ঘরের আগুন নিভে গেলেও মনের আগুনে ঝলসে ওঠে মা সিগনোর মারিয়ার ক্লান্ত মুখ আর সেই আগুন জমে শীতল হয়ে জল হয়ে বেয়ে আসে দুচোখ বেয়ে।
বয়ে চলা জীবনের কথা আস্তে আস্তে টোটোকে শোনাতে শুরু করে প্রজেক্টশনিস্ট আলফ্রেডো। বলেন, দেখো টোটো আজ যে ফেন্দি যন্ত্রপাতি দেখছো সব সময় এমনটি ছিল না। আগে ছবিগুলো নির্বাক। নড়তো কিন্তু কথা বলতো না। তখন এই প্রজেক্টর হাতে ঘুরাতে হতো। সারা দিন, মধ্যরাত পর্যন্ত হাতল ঘুরাচ্ছি তো ঘুরাচ্ছি। ক্লান্ত হয়ে পড়লেও বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই।
গাধার মতো খাটুনি। স্ত্রী আমার সুশ্রী তবু তার মুখটা বুকভরে দেখাই হলো না। চোখ আমার ঐ বিশাল পর্দায়। পয়লা বছর, বড় দিন, সবাই যখন অবসর সময় কাটায় আমি তখন হাতল ঘুরিয়েই চলেছি। একমাত্র গুড় ফ্রাইডে, ছুটি বছরের ঐ একদিন। আমি স্বল্প বুদ্ধির মানুষ। শৈশব কেটেছে যুদ্ধে, যৌবন কেটেছে যুদ্ধে, এই প্রজেকশন রুমের আলো বাতাস বিষাক্ত।
ক্যান্সার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তথাপি এই প্রজেকশন যন্ত্র আঁকড়ে বেঁচে রয়েছি। যখন দেখি হলরুম দর্শকে পরিপূর্ণ, দর্শক আনন্দে উৎফুল্ল তখন ভেবেছি এই আনন্দ উৎসবের আমিই হর্তাকর্তা বিধাতা। অন্তত তিন ঘণ্টা সময়ের জন্য হলেও আমি সমস্ত দর্শককে তাদের যাবতীয় সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছি। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি সম্ভব ছিল আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে।
আমি সুখী টোটো, আমি সুখী। কিন্তু টোটো তোমার জীবন আমার মতো হোক এটা আমি চাই না। একজন প্রজেকশনিস্ট হিসেবে এক সিনেমা তুমি একশবার চালিয়ে দর্শকদের দেখাতে পার কিন্তু সেখানে তোমার ভাবনা প্রকাশের সুযোগ কম। প্রজেকশান মেশিন চালনা আমি তোমাকে অবশ্যই শিখাচ্ছি কারণ যে কোনো কাজ করতে জানাটা গৌরবের কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত এ জীবনে তুমি কারও দাস হবে না। দাস যদি হতেই হয় সে দাস তুমি তোমার দাস।
কে যে কখন কার দাস হবে বলা কঠিন। এক রাত্রে সিনেমা হল প্যারাডিসো আগুনে পুড়ে গেলে আলফ্রেডো আগুনে পুড়ে ঝলসে দুচোখ হারায়। শিশু টোটোর কারণে সে যাত্রা আলফ্রেডো বেঁচে গেলেও আলফ্রেডোকে চলতে হয় আলফ্রেডোর স্ত্রী এবং টোটোর হাত ধরেই।
লোকের অভাবে টোটোকেই প্রজেকশন মেশিন চালাতে হয়। অবশ্য টোটোর পেছনে সারথী হয়ে থাকে আলফ্রেডো। দর্শক মাত্রই বোঝে জীবনের কোন অর্জনই ব্যর্থ হয় না। কাজটা শিখেছিল বলেই শত শত দর্শকের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছিল টোটো।
যৌবনে টোটো দর্শকদের চাহিদা পূরণে সক্ষম হলেও টোটোর চাহিদা পূরণে আলফ্রেডো অক্ষম। টোটো প্রেমে পড়েছে নীলনয়না আনার মাঝে। আনার বাবা কোটিপতি, পক্ষান্তরে টোটো এক সামান্য হলের প্রজেকশনিস্ট। উপরন্তু আলফ্রেডো চায় না দোকানদারের ছড়িয়ে রাখা মুড়ি খেয়ে পোলাও- এর স্বাদ থেকে টোটো বঞ্চিত হোক। বৃহত্তর দায়িত্ব পালন করবে যে টোটো তাকে ছোটখাট ভালোবাসা বিসর্জন দিতেই হবে।
আলফ্রেডো টোটোকে মানসিক প্রস্তুতির জন্য ছোট একটি গল্প বলে। বলে, একবার এক সেনা সে দেশের রাজার সাথে দেখা করতে এসে ফেরার মুহূর্তে রাজার কন্যার দেখা পায়। রাজকন্যাকে ভালোবাসার কথা জানালে রাজকন্যা বলে সেনাটিকে, যদি তুমি একশো দিন এবং একশো রাত আমার জন্য আমাদের বাড়ির ব্যালকনিতে দাড়িয়ে থাকতে পার তবে আমি তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করতে রাজি।
সেনা অফিসারটি তাই করলো। দিন পার হলো রাত পার হলো, সপ্তাহ গেল, মাস গেল। খরায় পুড়লো, শীতে জমাট বাধলো তবু সেভাবেই দাড়িয়ে থাকলো। তারপর যেদিন একশো দিন পূর্ণ হয়ে একশো রাত পূর্ণ হতে যাবে তার কিছুমাত্র আগে সেনা অফিসারটি চেয়ার টেনে বসলো।
রাজকন্যাকে শেষবারের মতো দেখে রাত শুরু হওয়ার আগে সেই যে সেনা অফিসার চলে গেল আর ফিরলো না। আলফ্রেডোর কাছে টোটো যতই কেন গেলর কারণ জানতে চাইলো আলফ্রেডোর উত্তর, তোমার জীবন থেকেই তুমি এর উত্তর জেনে নিও ।
নীলনয়না আনার সাথে দীর্ঘ প্রেমের টানাপোড়েন থেকে উত্তর খুঁজে পায় টোটো। টোটো আলফ্রেডোকে বলে, সেনা অফিসার শেষ রাতের আগ মুহূর্তে চলে গেছে কারণ সেনা অফিসারটি এই ভয়ে ভীত যদি রাজকন্যা শেষ মুহূর্তে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। তবে তো সেখানেই সেনা অফিসারটির মৃত্যু ঘটবে। বরং চলে গেলে আমৃত্যু এই কল্পনা নিয়ে বাঁচা যাবে যে রাজকন্যা তারই জন্য অপেক্ষায়।
অপেক্ষা করে সময় নষ্ট না করে আলোকিত পৃথিবীকে আরো আলোকিত করে মানুষের উন্মেষ ঘটানোর জন্য টোটোকে যে চলচ্চিত্রকার হতেই হবে সেভাবে উদ্বুদ্ধ করে আলফ্রেডো। কুয়ো ধরে ভেসে থাকার চেয়ে সমুদ্রে মেশার কথা বলে। এই গিয়ান্স অ্যালডো ছেড়ে ইতালির রাজধানী রোমে যেতে হবে তোমাকে টোটো। কাজ করার জন্য সে জায়গাই উত্তম।
আলফ্রেডো বলে, এখন এই সিসিলিয়া ভ্যালিতে থাকছো মনে হচ্ছে এটাই পৃথিবীর কেন্দ্র, কিছুই পরিবর্তিত হবে না। যখন বছর দুই পরে ফিরবে তখন সবই পরিবর্তিত। যা ফিরে পেতে চাও সেসবের অনেক কিছুই নেই। যা নিজের বলে জেনেছো তা চলে গেছে। তোমাকে অনেক দূর যেতে হবে, নিত্যনতুন ভাবনার অনেক উপাদান চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে দর্শকদের উপহার দিতে হবে।
এতদূরে তুমি যাবে, যে জায়গা থেকে তুমি তোমার জন্মস্থানে পুনরায় ফিরাবে স্বগৌরবে। টোটো, আমি চোখ ঝলসার কারণে অন্ধ আর তুমি মোহের ফাঁদে পড়ে অন্ধ। তুমি রোমে যাবে। আমি তোমার মুখ দিয়ে তোমার অনেক কথা শুনেছি এখন লোকের মুখ দিয়ে তোমার কথা শুনতে চাই। আলফ্রেডোর নির্দেশ শুনে সেই যে টোটো ইতালির মফস্বল শহর গিয়ান্সলেডো ছেড়েছিল।
সেই দিন থেকে আজকে আলফ্রেডোর মৃত্যুর সংবাদের মধ্য দিয়ে মধ্যবর্তী সময় পেরিয়েছে ত্রিশ বছর। এই ত্রিশ বছরের মধ্যে টোটো হয়ে গেছে ইতালি তথা সমগ্র বিশ্বের অন্যতম সেরা পরিচালক সালভেতর ডি ভিটা। চলচ্চিত্রের শেষে সালভাতর স্বগৌরবে বাড়িতে ফেরে। আলফ্রেডোর শবযাত্রায় সবার আগে অংশ নেয়।
প্রাক্তন প্রেমিকা আনার সাথে দেখা হলে আনা বলে যৌবনের ঐ সময় আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ আলফ্রেডো হওয়ায় আলফ্রেডোর উপর খুব রাগ হতো কিন্তু এখন বুঝি একমাত্র আলফ্রেডো তোমাকে ঠিক ঠিক বুঝেছিল। একটিমাত্র মেয়ের জন্য তোমার জন্ম না। চলচ্চিত্রের মতো বিশাল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে জগতের কল্যাণের জন্যই তোমার জন্ম।
মা সিগনোর মারিয়া বলেন, বাবা টোটো, যুদ্ধক্ষেত্রে আমি তোমার বাবাকে হারিয়েছি সত্য কিন্তু তিনি সবসময় আমার মধ্যে জীবিত তেমনই ত্রিশ বছর তুমি দূরে থাকালেও এ্যালফ্রেডোর স্বপ্ন আমার মধ্যে সদাই জীবিত যার রূপায়ণ এই ত্রিশ বছর ধরে তুমি করে চলেছো। মা হয়ে তোমাকে বৃত্তের বাঁধনে বাঁধিনি কারণ চলচ্চিত্রকার হিসেবে তুমি সর্বজনীন এবং সবার কন্ঠস্বর।
আলফ্রেডোর স্ত্রী বলেন, বাবা টোটো তোমার অবর্তমানে তার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে তোমার কথা ভেবে। টিভিতে তোমার সাক্ষাৎকার প্রচারের সময় শব্দ বাড়িয়ে দিতে বলতেন। তোমার নির্মিত সিনেমা প্রচারের সময় তার শারীরিক ব্যথা থাকতো না। পত্রিকায় তোমাকে নিয়ে লেখা বের হলে চারবার আমাকে তা পড়ে শোনাতে হতো।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এই ক্যান বাক্সটি তোমাকে দেওয়ার জন্য বলে গেছেন। ক্যান বাক্সটি নিয়ে চিত্রপরিচালক সালভেতর ডি ভিটার রোমে ফিরে নিজস্ব প্রজেকশন মেশিনে চালিয়ে দেখে শৈশবে বার বার আলফ্রেডোর কাছে চাওয়া ননসেন্সরড দৃশ্যের সেই সব অংশ। অপরিণত বয়সে যা টোটোকে দেয়া হয়নি অথচ টোটোর বায়নাকে মূলা দিয়েছিলেন বলেই না বলেছিল এগুলো তোমার কিছু থাকবে আমার কাছে।
পরিণত হলেই তুমি পাবে। আলফ্রেডো একজন প্রজেকশনিস্ট অন্ধকার ঘরের পর্দায় রং-বেরঙের ছবি ফোটানো তার কাজ। কাউকে কোনোদিন তিনি বঞ্চিত করেননি, টোটোকেও না। ভালোবাসার উচ্ছ্বাস প্রকাশের আলিঙ্গনের দৃশ্য দিয়েছেন টোটোকে তবে টোটোকে পরিণত সালভেতর ডি ভিটা বানিয়ে। খ্যাতিমান পরিচালক করে।
যে পরিচালক সালভেতর ডি ভিটা সেলুলয়েডের পর্দায় মানুষের জীবনের কথা ফুলে ফলে সাজিয়ে তুলবেন সেই পরিচালক মানুষটির জীবনের পথপ্রদর্শক আলফ্রেডোর প্রতি যে সুখকর অনুভূতি, যে আলফ্রেডোর মৃত্যুর শেষ বেলায়ও ব্যস্ত ছিলেন। ক্যান বক্স ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে টোটোর বায়নার প্রতি সম্মান জানাতে। শৈশবের টোটো আর আজকের সালভেতর ডি ভিটা। হিসাবের যোগ-বিয়োগ গুণ ভাগ মিলেমিশে টোটোর দুচোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রুধারা।
আরও দেখুনঃ