লা ভি অঁ রোজ 

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ লা ভি অঁ রোজ – আক্ষরিক অনুবাদ: গোলাাপী জীবন; অন্য নাম: ফরাসি: La Môme হল ফরাসি গায়িকা এদিত পিয়াফের জীবনীনির্ভর ফরাসি সঙ্গীতধর্মী নাট্য চলচ্চিত্র। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন অলিভিয়ার দাহান। এতে পিয়াফের ভূমিকায় অভিনয় করেন মারিয়োঁ কোতিয়ার।

লা ভি অঁ রোজ

 

লা ভি অঁ রোজ 

 

 

 

চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ :
ফ্রান্সের আত্মার কন্ঠস্বর এডিথ ফিফের সামগ্রিক গায়কি জীবনের টানাপোড়েন এবং গন্তব্যে পৌছানোর গৌরবগাথা নিয়ে অস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র।
দেশ                               : ফ্রান্স
পরিচালক                     : অলিভার ডাহান
লেখক                           : অলিভার ডাহাম
ইসাবেলা সোবেলম্যান
রিলিজ ডেট                  : অক্টোবর ২০০१
মুখ্য চরিত্র                     : মারিয় কোতিয়ার
সিলভিয়ে তেসতুদ
পাসকেল গ্রিগোরি

লা ভি অঁ রোজ

প্যারিসের আত্মার কন্ঠস্বর

চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত, প্রযোজিত এবং পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘লাইম লাইট’ দেখতে দেখতে পৃথিবীর আরো অনেক দেশের দর্শকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের কত শত-সহস্র দর্শক যে চোখ ভিজিয়েছেন তা কে বলতে পারেন। কেউ একজন সেটা হিসাব কষে না বলতে পারলেও ‘লাইম লাইট’ চলচ্চিত্র দেখা দর্শকমাত্রই বলতে পারেন জীবনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে কষ্টসহিষ্ণু সৃজনশীল শিল্পীদের চেষ্টা, অধ্যবসায় এবং ত্যাগের প্রতি বিনম শ্রদ্ধা জানাতেই জীবনের অভিজ্ঞতা অবলম্বনে চার্লি চ্যাপলিনের নির্মাণ ‘লাইম লাইট’ চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন বয়স্ক কমেডিয়াম নাম আলভেরো (চার্লি চ্যাপলিন), যার কাজ অভিনয়ের মাধ্যমে নাটক দেখতে আসা দর্শকদের হাসানো। মাথার ওপর গনগনে সূর্যও যেমন এক সময় পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে আঁধার রাতের পূর্বাভাস জানায়, ক্যালভেরোর জীবনও তেমনি আজ পড়ন্ত বেলায়।

জনপ্রিয়তা আজ আর নেই। নতুনের আগমনে সে নিজে বাসিদের দলে। মৌসুম শেষে উড়ে যাওয়া পাখির মতোই তার নাম- যশ-খ্যাতি সব আজ তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে অজানা দ্বীপে। অভিনেতা যখন দেখেন দর্শক তাকে আর চাইছে না, সেভাবে বিখ্যাত হিসেবে সমীহ করছে না তখন সে অভিনেতার আত্মবিশ্বাসও আর থাকে না।

আত্মবিশ্বাস যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে তেমনি এক মুহূর্তে তার সামনে এসে পড়েছে তার থেকে বয়সে অনেক অনেক ছোট কিশোরী, নাম টেরি। ব্যালে নাচের দলে কোরাসে নাচ করে টেরি। নাচলে লোকে বাহ্বা দেবে, টিকেটের টাকায় মালিক একটার জায়গায় দুটি বাড়ি বানাবে। কিন্তু দলের এক্সট্রা হয়ে নেচে যে দুটি পয়সা নিয়ে ঘরে ফিরবে সে সুযোগ নেই।

হয় নাচতে পেরে নাচার আনন্দে থাকো, নচেৎ দল থেকে বের হয়ে পথে ঘুরে ঘুরে মরো। ফলে টেরি তার জীবনের হতাশা আর দারিদ্র্যের বোঝার চাপ সইতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার। টেরির আত্মহত্যা করতে যাওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে পথ আগলে দেয়াল হয়ে আতাহননের পথে বাধা দেয় কমেডিয়ান ক্যালভেরো।

ঘৃণা করে নিজেকে নিজে মেরে ফেলার থেকে ভালোবেসে নিজেকে নিজে বাঁচিয়ে তোলার মধ্যেই যে নিজের স্বকীয়তা, জয় এবং আনন্দ সেটা বোঝায় টেরিকে ক্যালভেরো। স্নেহ, মমতা আর প্রেরণার জোরে এক সময় রুগণ, অসুস্থ এবং পঙ্গু টেরি নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে এবং পুনরায় নৃত্যশিল্পে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে।

মানুষ উত্তর দিকে হাটলে যেমন দক্ষিণ দিকে পৌঁছাতে থাকে তেমনি টেরির যত প্রতিষ্ঠা আসতে থাকে বিভিন্ন মিউজিক কোম্পানি থেকে বায়না আসতে থাকে ঠিক উল্টোটা ঘটতে থাকে প্রৌঢ় কমেডিয়ান ক্যালভেরোর জীবনে। তখন তার জীবনে ঘোর অমানিশা। না কোনো থিয়েটার দল থেকে ডাক আসে, না কোনো অনুরাগী ভক্ত সম্মান জানিয়ে দুটি পয়সা এনে ক্যালভেরোর হাতে তুলে দিয়ে যায়।

তবু মানুষ তো স্বভাবতই উপকার পেলে প্রতিদান দিতে চায়। ক্যালভেরোর দুর্দিনে ক্যালভেরোকে ভোলে না টেরি। অনেককে বলে-কয়ে, অনেক চেষ্টা করে ছোট। একটি চরিত্রে অভিনয়ের কাজ জোগাড় করে আনলো টেরি। আয়োজন করলো একটি বিশেষ সাহায্য রজনী, যে রজনীর সমুদয় উপার্জন তুলে দেয়া হবে ক্যালভেরোকে। বৃদ্ধ ক্যালভেরো টেরির চেষ্টায় বিস্মিত। তার দুচোখ বেয়ে নামে জলের ধারা। মানুষ তাহলে পুরোপুরি অমানুষ হয়নি।

এখনো মানুষ মানুষের যন্ত্রণা বোঝে। যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করে। টেরির চেষ্টার প্রতি সম্মান জানাতে বৃদ্ধ ক্যালভেরো মরিয়া। যেভাবেই হোক আজকের রজনী সফল করতেই হবে। হলভর্তি দর্শক। আলোর রোশনাই। সম্মুখে মঞ্চ। সারা জীবন অতিবাহিত এ মঞ্চ আর মঞ্চের দর্শকদের জন্য।

কিছুতেই দর্শকদের বঞ্চিত করা যাবে না। কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না কমেডিয়ান ক্যালভেরো বার্ধক্যের জ্বরা ব্যাধিতে নুয়ে পড়েছে, শেষ হয়েছে। আগুন নিভে যাওয়ার আগে যেমন একবার দপ করে জ্বলে ওঠে তেমনি শেষবারের মতো জ্বলে উঠলেন ক্যালভেরো। কিন্তু শরীর আর সইবে কত। শেষ নিঃশ্বাসটাকে আপ্রাণ চেপে ধরে শেষবারের মতো জীবনের সেরা অভিনয়টাকে দর্শকদের উজাড় করে দিয়ে এসে ছিটকে পড়লেন স্টেজের পাশে।

স্টেজে তখন নেচে চলেছে টেরি আর আস্তে আস্তে অচৈতন্য হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর অতলের গহ্বরে ডুবে গেলেন মঞ্চকে ভালোবেসে মঞ্চকে আঁকড়ে ধরে অভিনেতা বৃদ্ধ ক্যালডেরো। বৃদ্ধ ক্যালভেরোর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘লাইম লাইট’। ‘লাইম লাইট’ কাহিনীচিত্র, বৃদ্ধ ক্যালভেরো চরিত্রও কাল্পনিক। কিন্তু বাস্তব জীবনেও তো এ রকম ঘটনা অনেকের ঘটে। এ রকম একটি ঘটনা অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘লা ভি অঁ রোজ’।

বাংলাদেশে যেমন সাবিনা ইয়াসমীন, ভারতে যেমন লতামুঙ্গেশকর, তেমনি ফ্রান্সের আত্মার কণ্ঠস্বর এডিন ফিফের জীবনী অন । 2009 সালে যেমন আমেরিকান অন্ধ গায়কের চরিত অসামান্য অভিনয় করে সেরা অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন জেমি। , ঠিক তেমনি ২০০৮ সালে প্যারিসের আত্মার কন্ঠস্বর এডিন ফিফের চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পুরস্কার জিতে নিলেন ফ্রান্সের অভিনেত্রী মারিয় কোতিয়ার।

অলিম্পিয়া মঞ্চে জীবনের শেষবারের মতো গান গাওয়া, সেটাকে এডিথ ফিফ নিজেই বলেছেন সুইসাইড জার্নি, সেই গান গাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুতে এডিথ ফিফের স্মৃতিচারণায় ভর করে আস্ত এডিথ ফিফের সামগ্রিক গায়কি জীবন অবলম্বনে ফ্রান্সের পরিচালক অলিভার ডাহানের ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র লা ভি অ রোজ ।

চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় আলো-আঁধারির হল দর্শকে পরিপূর্ণ। মঞ্চের পর্দা ধীরে ধীরে উঠছে। গ্রাম অঞ্চলে মাছ ধরার জাল শুকাতে দিলে দেখতে যেমন লাগে অর্থাৎ বৃত্তাকারে উপরের দিক থেকে নিচের দিক ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে যেন সবকিছুকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে, অনেকটা সে রকমভাবে মঞ্চের ওপর থেকে টপ অ্যাঙ্গেলে একটি আলো এসে মঞ্চের মধ্যে বৃত্তাকার জোন তৈরি করেছে।

সেখানে স্ট্যান্ডে মাইক্রোফোন বকের মতো গেলা বেঁকিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে তার মনিবের আসার অপেক্ষায়, যিনি এলে তার যান্ত্রিক জীবনে হবে প্রাণের প্রতিষ্ঠা। মঞ্চের পিছনে সারিবদ্ধভাবে নানান অর্কেস্ট্রা, গিটার, পিয়ানো, ড্রাম নিয়ে প্রস্তুত যন্ত্রকুশলীরা। হলভর্তি দর্শক অধীর আগ্রহে আর কতক্ষণে আসবে তাদের আত্মার আত্মা, মরমী মানুষের বৃষ্টিধারা, প্যারিসের আত্মার কণ্ঠস্বর পৃথিবী বিখ্যাত গায়িকা এডিথ ফিফ।

সব ব্যাকুলতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসুস্থতায় ঝুঁকে পড়া নীল চোখের অধিকারিণী এডিথ ফিফ আস্তে আস্তে হেঁটে মঞ্চে ঢোকেন, আলোক রশ্মিতে আঁকা বৃত্তের গণ্ডিতে পা রাখেন, মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়ান। পাখির চঞ্চলা চোখের মতো চোখ নিয়ে এডিথ ফিফ একবার তাকিয়ে নেয় ডানে, বাঁয়ে আবার সামনে।

এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা মনটাকে মুহূর্তে গুটিয়ে নেয়া লাটাইয়ের মতো গুটিয়ে নেন নিজের মধ্যে। একজন অভিনেতা, একজন বাঁশিবাদক কিংবা একজন গায়ক-গায়িকা মূলত তিনভাবে দম নিয়ন্ত্রণ করে তার করণীয় কাজটা করেন। গাছের মাটির তলের অংশ যেমন মূল, গাছের মধ্যবর্তী অংশ কাও, আবার সবার ওপরের অংশ ডাল-লতাপাতা তেমনি শিল্পীদের মূল অংশটা পেটের অংশ, কাণ্ডের অংশটা গলা আর ডাল-

লতা-পাতার অংশ মস্তিষ্ক। এ মস্তিষ্কের অংশ নিয়ে বেশি ভালো পারফরমেন্স আরো অনেকের মতো বাংলাদেশে যারা বেশ আলোড়ন তুলেছেন তারা হলেন জেমস, বারী সিদ্দিকী, নকুলকুমার বিশ্বাস, এসআই টুটুলসহ আরো অনেকে। পেট, গলা, মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণে রেখেও মূলত হেড রেজিস্ট্রারের ওপর দরদ ঢেলে জীবনের শেষ গানটি গান এডিথ ফিফ।

আমরা যারা দর্শক সারিতে বসে, আমরা যারা ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফ্রেঞ্চ ভাষা লিখতে পড়তে কিছুই পারি না তাদের একমাত্র ভরসা ইংরেজি সাবটাইটেল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পাখির ডাক, সুর, ঝরনাধারা, বাতাসের হিল্লোল, সমুদ্রের ঢেউ প্রভৃতির নিজস্ব একটা সুর ও ছন্দ আছে।

পৃথিবীর যে কেউই মূল ভাবটা বুঝতে পারে। এটা বোঝার জন্য ভাষার দরকার হয় না। তেমনি গানের সুর বুঝতে আমাদের কারো অসুবিধা না হলেও গানের কথা বুঝতে তো মনোযোগ থাকা দরকার। কিন্তু এডিথ ফিফের স্বকণ্ঠে গাওয়া গান পরিচালক অলিভার ডাহান এ চলচ্চিত্রে যুক্ত করেছেন।

ফলে এডিথ ফিফের মূল গান এবং এডিথ ফিফের চরিত্রে মারিয় কোতিয়ার অনবদ্য অভিনয়ের যে মনোনিবেশ, তাতে যে ঘোর তৈরি হয় সেই ঘোরে আমরা দর্শকরা দিশেহারা। সাবটাইটেলের দিকে দৃষ্টি রাখার সুযোগ কোথায়। তবু চলচ্চিত্রের ভিতরে দর্শকদের গুনগুনিয়ে গাওয়া এবং চলচ্চিত্রটি দেখছে যারা, তাদের গুনগুনিয়ে গাওয়াকে অবলম্বন করলে প্যারিসের কন্ঠস্বর এডিথ ফিফের গাওয়া জীবনের শেষ গানটির মানে যা দাঁড়ায় তা অনেকটা এ রকম—

না……. না…. না, কোনো কিছুই কিছু না

কোনো আক্ষেপ কোনো দুঃখ কিছুই কিছু না

সুখের ডানায় ভেসেছি যখন

দুঃখের ব্যথায় ডুবেছি যখন

তাই সব পুড়িয়েছি আগুন জ্বেলে

সেসব আজ আর কিছুই কিছু না।

যে অতীত ডুকরে কাঁদে

যে মোচড় আমায় ভেঙে ফেলে

সে সব আজ আর কিছুই কিছু না।

কত কত পদক জুটেছে

গলে পুরস্কার তিরস্কার সবই এক সাথে

ভেবেছি যেসব অমর রবে

সে সবই দেখি ভাসে বানের তোড়ে

সে সবই আজ আর কিছুই কিছু না….

ভাবি শুরু করি আজ নবসাজে

যে জীবনে আমি আপনাদের সাথে

সেটুকুই হোক জীবন ধারণ

আর কিছুই কিছু না….

কিছুই কিছু না…।

প্যারিসের শ্রেষ্ঠ গায়িকা নিউইয়র্কে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এত মস্তবড় গায়িকা এডিথ ফিফ বলছে সে কিছুই কিছু না। অহঙ্কার করার মতো জায়গা থাকা সত্ত্বেও এ নিরহঙ্কার মনোভাবে দর্শকদের মাথা নিচু। ফলবতী গাছ যেমন। নুইয়ে পড়ে তেমনি জীবনের ব্যালাপশিটে অসংখ্য সফলতা অর্জনের পরও এডিথ ফিফ নিরহঙ্কারী।

এ গানটি গাইতে গাইতেই মঞ্চের ওপর ছিটকে পড়ে অচৈতন্য হয়ে যায় এডিথ ফিফ, হাসপাতাল ডাক্তার প্রভৃতি দৌড়াদৌড়ি শেষে এডিথ ফিফ এখন বিছানায় শায়িত। তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে জীবনের ফেলে আসা একেকটা ঘটনার কথা। পরিচালক অলিভার ডাহানের নির্দেশে ক্যামেরাম্যান টেটসুও নাগাতার ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে দর্শক ফিরে চলে ১৯১৮ সালে প্যারিসের এক রাস্তায় যেখানে শিশু এডিথ ফিফ একা একা দাড়িয়ে কাঁদছে।

একা এক শিশুকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে এক পথচারী ভদ্রমহিলা শিশু এডিথকে ফিরিয়ে দেয় তার মায়ের কাছে। এডিথের মা তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান করছে, যাতে দুটি ফ্রাঙ্ক সংগ্রহ করা যায়। এ মায়ের সাথে এডিথের সম্পর্ক কোনোকালেই ভালো যায়নি। সেটা চলচ্চিত্রে বার বারই ঘুরেফিরে এসেছে। প্রথম অসুবিধা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান করবো, না মেয়েকে ধরে ধরে রাখবো । দ্বিতীয়ত, এক সময় মনে হয় এডিথ ফিফের মধ্যে গায়িকা হয়ে ওঠার প্রবণতা রয়েছে।

ফলে কাক যেমন কাকের মাংস খায় না তেমনি এডিথকে এডিথের মায়ের বেশি পছন্দ না। উপরন্তু একজন মানুষের মধ্যে কাজ ফেলে রেখে সেলিব্রেটি হয়ে ওঠার প্রবণতা যখন মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ পায়, তখন তার পক্ষে সুস্থ থাকাটা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এডিথের মায়ের ধারণা সে মস্তবড় গায়িকা।

তার অহঙ্কার সে গায়িকা। সে যে মস্তবড় গায়িক সেটা সে একাই বোঝে। ফ্রান্সের লোকে কেন গলায় স্বাকৃতির মালা পরালো না এক্ষেত্রে তার অকাট্য যুক্তি, তার গান বোঝার মতো যোগ্য লোক তামাম ফ্রান্সে নেই। তার মতে, মূর্খ কীভাবে জ্ঞানীর কদর বুঝবে। অন্যকে মূর্খ ভাবার মতো মূর্খামি যে আর দ্বিতীয়টি নেই সেটা জ্ঞানী মাত্র বুঝলেও বোঝে না এডিনের মা। ফলে

তাকে তার বাসস্থান ছাড়তে হয়। এডিথের বাবা একজন কামলা খাটা মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষে সৈন্যদের বাঙ্কার তৈরির জন্য নর্দমা কাটার কাজ করে এডিথের বাবা। এডিথের মা তার স্বামীকে বাড়ি ফিরে এসে মেয়েকে দেখাশোনা করতে বলে। কারণ গায়িকা হওয়ার জন্য তাকে এ মফস্বল বেলভিলে থাকলে চলবে না। স্বামী ফিরতে দেরি করায় এডিথের মা, এডিথকে নিজের মায়ের কাছে রেখে চলে যায়। মাশূন্য এডিথের হাসফাস দশা।

হাঁসফাঁস দশা নিয়ে ঘরে ফেরে এডিথের বাবা। কিন্তু এ কী দশা তার শাশুড়ি আর নিজের মেয়ের। ভাইরাস জ্বরে দাদী-নাতনী দুজনেরই মরণদশা। মোটা কম্বলের তলে চাপা পরে মেয়েটা তো আমার মরেই যাবে। আহা রে, কয়টা দিন আমি ঘরে নেই, এর মধ্যে মেয়েটি আমার মরতে বসেছে। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে মেয়েটা আমার। আহারে আমি কেন এত দেরি করে ফিরলাম। ওঠো মা, ওঠো। আমি তোমাকে এখানে কিছুতেই রাখবো না। আমি তোমাকে দূরে নরম্যান্ডিতে নিয়ে যাবো।

সেখানে আমার মা আছে। তুমি তার কাছে থাকবে। খোলা আকাশ আছে, সবুজ ঘাস আছে, পাশে গির্জা আছে সেখানে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। মেয়েটার আমার চোখের – নিচে কালচে হয়ে গেছে। ওঠো মা, ওঠো। এতদিন পর বাবা বাড়িতে ফিরেছে, পরম মমতা নিয়ে পিতৃস্নেহ ঢেলে দিচ্ছে।

মেয়েটি যে বাবার কোলে। উঠবে সেটুকুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। যেই মাত্র এডিথের বাবা এডিথকে টেনে কোলে তুলতে নিয়েছে অমনি এডিথ যেভাবে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বাবার বুকের ওপর এলিয়ে পড়লো তাতে হলভর্তি দর্শক নিশ্চুপ। মানুষ যখন দীর্ঘ পরিশ্রমে গন্তব্যে পৌঁছায়, ঘরের আঙিনায় নিজের বিছানা পায় তখন হাতের লাগেজ ফেলে দিয়ে যেভাবে হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে অনেকটা সে রকম অবস্থা উপস্থিত দর্শকদের।

পিতা-কন্যার এ মধুর সম্পর্কের সূত্র ধরে এক পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বামী তার স্ত্রীকে বললেন, এবার বুঝলে তো রুমকির বিয়ের সময় কেন আমি দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলাম! স্ত্রীরও পাল্টা জবাব, মেয়ে যেন শুধু তোমার একার? সঙ্গে সঙ্গে এক ইঁচড়ে পাকা দর্শকের উপদেশ, এক্সকিউজ মি, এখানে ঝগড়া করবে না।

মেয়েকে ঝগড়া-বকাঝকা না করার জন্য মিনতি জানিয়ে নিজের মায়ের কাছে মেয়েকে রেখে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যায় এডিলের বাবা। এডিথের পানী আবার দশ-বারোজন দেহপসারিণী রেখে একটি বার চালায়। লোলুপ, কামুক কাস্টমারদের জন্যই এ দেহপসারিণীর মিলনমেলা। থালা বাটি হাঁড়ি পাতিল

মাজতে যেমন ছাই লাগে তেমনি সমাজের সংযমের রাস টেনে রাখতে ভূমিকা রাখে তারা। সব শ্রমে কমবেশি পেনশান থাকে। এই শ্রমে সে সুযোগ নেই। গায়ে গতরে যতদিন সমর্থ ততদিন আয়। যেই জরা-ব্যাধি-বার্ধক্যে চামড়া স্কুলে গেল সে-ই সব শেষ। অবলম্বনের মতো স্বামী নেই, বার্ধক্যে পাশে দাঁড়ানোর জন্য সন্তান নেই।

তাই সময় থাকতে থাকতে বাড়তি দুটি পয়সা ধরে রাখার জন্য তারা মরিয়া। তবু জার্মান নাট্যকার ব্রেখটের নাটক ‘গুড পাসন অব সেচুয়ানে’ যেমন দেবদূতরা ভালো মানুষ খুঁজতে সব থেকে ভালো মানুষটিকে এসে খুঁজে পেল সেচুয়ানে, যার পেশা দেহবিক্রি তেমনি এডিথ ফিফ খুঁজে পেল চিটনিকে।

শিশু এডিথকে পেয়ে টিটনি যেন তার সস্তান পেল। ডিম ফুটে হাঁসের বাচ্চা যে প্রবৃত্তিরবশে পুকুরের জলে দৌড় লাগায় তেমনি অপরিণত বয়সের কোনো এক প্রবৃত্তির কারণে মেয়েরা দুটি জিনিস নিজে নিজেই বুঝে যায়। প্রথমটা হলো মা-বাবার ঘরে সে অতিথি, তার আসল ঘর তার স্বামীর ঘর। দ্বিতীয়টি হলো আজ হোক আর কার হোক সে শুধু কুমারী রবে না, সে মা হবে। মাতৃত্ববোধ পাথরে চাপা আগুনের মতো লুকিয়ে থাকে আরো অনেকের মতো টিটনির হৃদয়ে।

আজ এতদিন পর এডিথকে পেয়ে টিটনি দিশেহারা। এ-গোসল করায় তো এই পোশাক পরায়। এই মাথায় শ্যাম্পু ঢালে তো এই চোখে কাজল লাগায়। যা থেকেও মাতৃত্বের স্নেহবঞ্চিত এডিথ টিটনির কাছ থেকে প্রকৃত মায়ের স্নেহ পেয়ে পাহাড় থেকে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে পড়া ঝরনা ধারার মতো হরিণী চঞ্চলা। মাহারা সন্তান মাত্র জানে জীবন চলার পথে সব বঞ্চনাই বঞ্চনা। কারণ সে যাহারা। গামলার জলের মাঝে শিশু এডিথকে ভাসিয়ে ফ্রান্সের ফ্রেঞ্চ ভাষায় টিটনি যে গানটি গায় তার অর্থ অনেকটা এ রকম—

বেরিয়েছি সাঁতরাবো বলে হ্রদের জলে। তবু কেউ নেই যে দেখে আমায় দুনয়ন ভরে

আমি একা একা সেই সে ওই সুদূরে গা ভাসাই ভেজা গায় হ্রদের জলে

হঠাৎ দেখি ওই দূর নীল আকাশে চাঁদ মামা উকি মারে আমার পানে বলছে ডেকে দীপ্তি জ্বেলে জ্যোৎস্না ঢেলে। ভয় নেই ওরে সোনামণি একা ভেবে

কথা দিচ্ছি জগৎ এবার দেখবে তোকে ভয় নেই ওরে সোনামণি একা ভেবে এই টিটনির কাছ থেকেই এডিথ ফিফ বোঝে লোকের প্রশংসা পাবো বলে শুধু গান গাইলে চলে না। গানের সুরে দরদ ঢেলে, গানের কথায় নিজের অভিব্যক্তি ঢেলে, চেষ্টায় গাইতে হয়। আর কণ্ঠ সে তো এই চাঁদমামার জ্যোত্রা ঢালার মতো। আধ্যাত্মিক রুপা, করুণাময়ের আশীর্বাদ পেলে সে গান কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর গান যখন জীবন্ত হয়ে ওঠে তখন দর্শক-শ্রোতারা গায়ক- গায়িকার গলায় বরমালা পরিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করেন না।

মাতৃত্ব ঢেলে দিতে টিটনি কার্পণ্য বোধ না করলেও মাতৃত্ব বেশি প্রকাশের কারণে লোলুপ কাস্টমার যে হাতছাড়া হচ্ছে সেটা ভেবেই এডিথের দাদী ওরফে সর্দারণী যারপরনাই ক্ষুব্ধ। তার একটাই কথা, ওরে ডায়মন্ড কুইন, এবার তুই তোর নাটক থামা। বেলা পড়ে যাওয়ার আগে যদি দুটি মুদ্রা বেশি তুলতে না পারিস তবে আমার ঘর খালি করে দে। ওই নীল চোখের নীল নয়নারে নিয়ে তুই দূর হ।

মা-দাদী যে পথে চলেছে সে পথে চলবে না, মা হবে। কাঁটা মারি তোর পোড়া মুখে। সর্দারণীর কথায় টিটনির মুখ না পুড়লেও এক সন্ধ্যায় এডিথ বলে, টিটনি টিটনি আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। জেমি কক্স অভিনীত অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘রে’ যারা দেখেছেন তারা সবাই জানেন আমেরিকার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আমেরিকার অন্ধ গায়ক রে তার এক ছোট ভুলের কারণে যেমন চোখের সামনে গামলার পানিতে পড়ে আপন ছোট ভাইয়ের মৃত্যু দেখে মৃত্যুর শোক ভুলতে না পেরে যেভাবে আস্তে আস্তে চিরদিনের মতো অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, প্যারিসের আত্মার কন্ঠস্বর এডিথ ফিফের অবস্থাও অনেকটা সে রকম।

টিটনির তখন একটাই অনুতাপ, এতদিন পর ঈশ্বর যদিওবা একটা সন্তান পাঠিয়েছে তাও সে চোখের সামনে অন্ধ হয়ে যাবে। না না, কিছুতেই না। অন্তত টিটনি বেঁচে থাকতে না। টিটনি তার সঞ্চিত ফ্রাঙ্কের বিনিময়ে চোখের ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার সবকিছু দেখেশুনে নিশ্চিত হয়, এডিথের কর্নিয়ায় ইনফেকশন। যৎসামান্য চিকিৎসা, বাদবাকিটা পরম করুণাময় ভরসা। এডিথের চোখে পটি বেঁধে দেয় টিটনি।

এখন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। মানুষ যখন নিজের চেষ্টা, দশজনের সহযোগিতায় অথৈ সমুদ্রে কূল খুঁজে না পেয়ে বিভ্রান্ত তখন অবলম্বন হোক কিংবা বিশ্বাসের নির্ভরতা হোক সে নির্ভর করে পরম করুণাময়ের উপর। টিটনি এডিথকে নিয়ে যায় কাছের গির্জায়। টিটনি হাতজোড় করে বলে, হে সেইন্ট তেরেসা। এই পঙ্কিল জীবনে আমি কোনোদিন তোমার কাছে কিছুই চাইনি। অর্জিত পুণ্য বলতেও আমার কিছু নেই।

কিন্তু তুমি তো জান, ভগবান যিশু বলেছেন, শোকার্তরাই ধন্য কারণ তারা সান্ত্বনা পারে। আজ আমি সত্যিই শোকার্ত। আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন এডিথের দুচোখ ঝাপসা। সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এতটুকু শিশু চোখ ছাড়া কীভাবে চলবে? তুমি তার অন্ধ চোখে আলো ফোঁটাও। সেইন্ট তেরেসা তুমি পথ দেখাও। এডিথকে বলতে বললে এডিথ বলে, সেইন্ট তেরেসা, আমি গাছপালা পাখি নদী আঙুরের ক্ষেত নীল আকাশ দেখতে চাই। বইয়ের মধ্যে যত লেখা সেসব পড়তে চাই।

তুমি আমার চোখ ঠিক করে দাও সেইন্ট তেরেসা, চোখ ঠিক করে দাও সেইন্ট তেরেসা। চোখ বাঁধা পটি ভিজে যায়। এডিথের চোখের জলে। হলভর্তি দর্শকও নিশ্চুপ। এই শিশুর আহ্বান উপেক্ষা করার শক্তি যেমন মর্ত্যের মানুষের নেই তেমনি নেই দেবলোকের দেবীর।

এক সকালে বেঞ্চে বসা এডিথ কিফ চোখে বাঁধা পটি আস্তে আস্তে খুলতে থাকে। কুয়াশার মধ্য থেকে এগিয়ে আসা একটি মানুষ যেমন আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে অনেকটা সেভাবে এডিথ কিফের সামনে স্পষ্ট হতে থাকে গাছের ডালের সবুজ পাতা, দূর আকাশে ভেসে বেড়ানো কাশফুলের মতো শরতের থোকা থোকা মেঘের ভেলা, পুকুরের জলে ভেসে বেড়ানো রাজহাঁসের দল।

অর্থাৎ এডিথ ফিফ চোখে দেখতে পাচ্ছে। টিটনি, টিটনি আমি দেখতে পাচ্ছি। এডিথ তুমি দেখতে পাচ্ছ। ওরে আমার সোনারে, জাদুরে, চাঁদের কণারে, আমার মনা দেখতে পাচ্ছে। আমার এডিথ দেখতে পাচ্ছে। তোরা কে কোথায় আছিস একবার এদিকে আয়। দেখে যা আমার এডিথ দেখতে পাচ্ছে

আর দেখা! দেখা যা যায় না অথচ দেখতে হবে তাই তো ভবিতব্য মানুষের চার আঙুলের কপাল বড় অদ্ভুত। সেখানে কী সুখ কী দুঃখ, কোনো কিছুই বেশিক্ষণ আসন পেতে বসতে পারে না। এডিথ ফিফের পিতা লুইস ফিরে এসে পুকুরের জলে ডুবে থাকা মাছকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার মতো করে সবার বাধানিষেধ উপেক্ষা করে এডিফ ফিফকে নিয়ে যায়। হতে পারে টিটনি এডিথকে গর্ভে ধরেনি কিন্তু বুকে তো ধরেছে। বুক-কোল ছিন্ন করে। আজ তার এডিথকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এ যন্ত্রণা সওয়া যায় না। মাটিতে পড়ে টিটনি বিলাপ করে তবু যা যাওয়ার তা চলে যায়।

সামনের থেকে চলে যাওয়া মানেই যে মনের থেকে মুছে যাওয়া নয় সেটি। বোঝাতে পরিচালক অলিভার ডাহান একটা চমৎকার দৃশ্য সংযোজন।

করেছেন। এক গোধূলিবেলায় এডিথ ফিফের মনে হয়, সেইন্ট তেরেসা যেন তাকে জিজ্ঞাসা করছে, এডিথ তুমি চোখ ফিরে পেতে চেয়েছিলে কেন? উত্তরে এডিথ ফিফ বলে, চেয়েছিলাম, কারণ টিটনি চেয়েছিল বলে। দুঃসময় পার হয়ে সুসময়ে পৌঁছে দুঃসময়ের প্রকৃত আপনজনকে যে এডিথ ফিফ ভোলেনি তাতে খুশি হয়ে সেইন্ট তেরেসা যেন বলে, এডিথ তুমি অকৃতজ্ঞ নও, তোমার আর পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। অতীতকে ভুলে যাওয়ার যে মোহ সেই মোহ তোমায় গ্রাস করেনি এডিথ। এডিথ তুমি বড় হবে, অনেক অনেক বড়।

বড় হতে চাইলেই যে বড় হওয়া যাবে এমন তো নয়। এডিথের বাবা লুইস তো চেয়েছিল সার্কাসের দলে মনপ্রাণ ঢেলে সার্কাসের সেবা করলে সার্কাসের দলও বড় হবে, সেই সঙ্গে সে নিজেও বড় হবে। কিন্তু ওই যে বলে, দল থাকলেই দলাদলি। দলাদলির ফলাফল দল ভাঙন। ফলে সার্কাসের দল ছেড়ে লুইস এডিথকে সঙ্গে নিয়ে উঠে আসে ফুটপাথে।

সার্কাসের ক্লাউনরা যেমন হাত-পা ভাঁজ করে নানা রকম খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মন জুগিয়ে দুটি বাড়তি বখশিশ আশা করে, এডিথের বাবাও অনেকটা সে রকম করে। খেলা দেখা এক জিনিস আর গুনে গুনে ফ্রাঙ্ক দেয়া অন্য জিনিস। প্যারিসের রাস্তায় উপস্থিত এক দর্শক এডিথের পিতা লুইসকে বলে, ফ্রাঙ্ক দিতে রাজি আছি যদি ওই দাড়িয়ে থাকা আপনার মেয়ে কিছু একটা করে দেখায়।

পিতা লুইস মেয়ে এডিথ ফিফকে বলে, মা কিছু একটা করো। কথা নেই বার্তা নেয় কিছু একটা করো। কী করবে বুঝতে না পেরে এডিথ যখন দিকভ্রষ্ট তখন বাবার হাতের তিন ধাক্কা খেয়ে এডিথ না বুঝে না ভেবে শুরু করে দেয় ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। সঙ্কটে সম্ভাবনা হয়ে ধরা দেয় এ গান।

আর যায় কোথায়—দশ বছরের মেয়ে এডিথের জাদুমাখা কণ্ঠে গাওয়া জাতীয় সঙ্গীত শুনে উপস্থিত দর্শক এবং আশপাশের সব পথচারী এডিথকে ঘিরে ভিড় করে যার যার মতো করে দেশপ্রেমের প্রতি সম্মান জানায়। গান শেষ হলে অকল্পনীয় ফ্রাঙ্কের মুদ্রায় ভরিয়ে দেয় পিতা-কন্যার চার হাত।

এই ছোট্ট ঘটনাই আজীবন পিছন থেকে প্রেরণা জোগায় এডিথ ফিফকে। এডিথ ফিফ দর্শকরূপী আয়নায় নিজের যে চেহারা দেখে তাতে সে বোঝে, তার গান লোকে শোনে, গানের মূল্য দেয়। এডিথ ফিফ নিশ্চিত হয়, একদিন সে হবে ফ্রান্সের অন্যতম সেরা গায়িকা।

গায়িকা হবে না ছাই হবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভয়াবহ পরিণতিতে ব্যর্থতায় পড়া এডিথের মা যখন সুরাপানের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে মেয়ের যৎসামান্য দেয়া নিয়ে মুহুর্মুহু অভিশাপ ছড়াচ্ছে, তখনকারই সংলাপ তুই গায়িকা হবি না ছাই হবি। তুই তো গানের গ-ও জানিস না। আমিই গায়িকা, সেরা গায়িকা।

 

লা ভি অঁ রোজ 

 

সেরা গায়িকা মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে বান্ধবী মোমনের হাত ধরে বার ছেড়ে পালায় দুই বান্ধবী। জীবনের চলার পথে বন্ধুভাগ্য সবার জোটে না। বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় ডিপ্লোম্যাট চানক্য যেমন বলেছে, উৎসবের সময়, বিপদের সময়, দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ হলে, বিচারালয়ে, শশ্মশানে সর্বদাই যিনি সহায় হন তিনিই প্রকৃত বন্ধু। মোমনে তেমনই প্রকৃত বন্ধু এডিথ ফিফের জীবনে। মোমনে সব সময় বিশ্বাস করেছে, সে হলো নৌকা যে নৌকায় চড়িয়ে এডিথকে নদী পার করে দিতে হবে। –

নদী পার না হলেও প্যারিসের লম্বা রাস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে এডিথ ফিফ গান ধরে আর মোমনে খালি কৌটা এগিয়ে ফ্রাঙ্কের তোড়া তোলে। কৌটা ভর্তি হয়ে গেলে দুই বান্ধবী পেট ভরে খাবার খায়। এ রকম এক রাতে এডিথ ফিফের গান শুনে এগিয়ে আসে নাইট ক্লাবের মালিক লুই লোপ্পে। পাকা মাছ শিকারি যেমন পুকুরের জলে হাত দিয়ে বুঝতে পারে এ পুকুরে চেলা-পুঁটি না রুই-কাতলা তেমনি এডিথের সামান্য গাওয়া গান শুনে ক্লাবের মালিক লুই লোপে বুঝে যায় এডিথ ফিফের বড় গায়িকা হয়ে ওঠার নিশ্চিত সম্ভাবনা।

দুটি পাঁচশো ফ্রাঙ্কের নোট আর দুটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সামনের সন্ধ্যায় আসার নিমন্ত্রণ জানায় লুই লোপে। এডিথ ফিফ শুধু একবার বলে, আমরা তো পথের গায়িকা। আমাদের কোনো ঠিকানা আপনার জানা নেই। আমরা যদি না যাই তবে তো আপনার অর্থটাই খোয়া যাবে। প্রতিউত্তরে লুই লোপ্পে বলে, তুমি যদি অর্থের কাঙাল হবে তবে আমি তোমায় দিতাম না। তুমি নিশ্চিত আসবে কারণ তুমি গানের কাঙাল ।

লুই লোপের কথামতো নাইট ক্লাবে আসে এডিথ ফিফ। পরীক্ষামূলক সঙ্গীত পরিবেশনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এডিথ ফিফের জীবনে এটিই মূলত টার্নিং পয়েন্ট। বিশোর্ধ্ব এডিথ ফিফ যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান পরিবেশন করে সেই মঞ্চ উপযোগী পোশাক তার ছিল না।

লুই লোপ্পে দর্জি ডেকে মাপজোখ নিয়ে কালো রঙের পোশাক বানিয়ে দেয়। এ পোশাকটিই পরে এডিথ ফিফের ব্যান্ড পোশাকের মর্যাদা লাভ করে। শিল্পীদের নামকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এডিথ ফিফের মূল নাম খুবই লম্বা এবং উচ্চারণে অসুবিধা । এডিথ জিওভানা গ্যাসিওনকে হোটেল মালিক লুই লোপে সময় উপযোগী এবং চমৎকার নাম দেয় লিটল স্প্যারো। ইরানের পরিচালক মাজিদ মাজিদির অনবদ্য নির্মাণ চলচ্চিত্র যেমন চিলড্রেন অব হ্যাভেন, কালার অব প্যারাডাইস

বারান, সেই পরিচালক মাজিদ মাজিদির সর্বশেষ নির্মাণ দ্য কালার অব স্প্যারো চলচ্চিত্রটির নামের মানে বুঝতে গিয়ে বোঝা যায় ”প্যারো বলতে পাখিকে বোঝায়। তাহলে লিটল স্প্যারো অর্থ দাঁড়ালো ছোট পাখি। এডিখ ফিফের ব্যাপক পরিচিতি আসে লিটল স্প্যারো নামে।

বাংলাদেশে বংশীবাদক বারী সিদ্দিকীর গায়ক পরিচয়ে পরিচিতি হওয়ার ক্ষেত্রে আবিষ্কারক বলি আর পথপ্রদর্শক বলি তা যেমন হুমায়ূন আহমেদ তেমনি এডিথ ফিফের বিখ্যাত গায়কি জীবনের আবিষ্কারক এবং পদপ্রদর্শক ওই নাইট ক্লাবের লুই লোপ্পে। লুই লোপের তত্ত্বাবধানে লিটল স্প্যারো তখন প্যারিস রেডিওর সেরা শিল্পী। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তখন লিটল স্প্যারোর জয়জয়কার।

কিন্তু ওই যে বলে মানুষের কপাল চার আঙুল মাপের। সুখ কিংবা দুঃখ কেউই বেশিক্ষণ আসন পেতে বসে না। যে লুই লোপের কারণে লিটল স্প্যারোর জয়জয়কার সেই লুই লোপে হঠাৎ এক রাতে খুন হয়ে গেলেন। গোয়েন্দা সংস্থার নিশ্চিত ধারণা, লুই লোপ্পেকে খুন করেছে মাফিয়া এবং মাফিয়াদের সহযোগিতা করেছে লিটল স্প্যারো।

লিটল স্প্যারো যত চিৎকার করেই বলুক যিনি আমাকে ফুটপাথ থেকে তুলে এনে রাজপথের রাজ সিংহাসনে বসিয়েছেন, তাকে আমি মারতে যাবো কেন? গোয়েন্দা সংস্থার পাল্টা প্রশ্ন-মাফিয়া চক্র আপনার ভক্ত, নিয়মিত আপনার অনুষ্ঠানে এসেছে, হত্যার পরিকল্পনা করেছে, তারা সংগঠিত হতে পেরেছে আপনাকে কেন্দ্র করে।

ফলে আপনি কীভাবে এ দোষ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন? লিটল স্প্যারো বলে, একই আলোর নিচে বসে কেউ জাল দলিল লেখে আবার কেউ বাইবেল পড়ে— তাই বলে ভালো- মন্দের সঙ্গে আলো যুক্ত হয়ে যায় না। আমি শুধু একজন গায়িকা, খুনি নই। এখানে পরিচালক অলিভার ডাহান প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকর্মীদের সঙ্গে লিটল স্প্যারোর বাদানুবাদ দিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দর্শকদের দিতে চেয়েছেন।

তা হলো মিডিয়ার ফোকাস যেমন একজন প্রতিভাবানকে জনসমক্ষে তুলে আনতে পারে তেমনি সেই ফোকাস প্রতিভাবানকে ঝলসিয়ে নির্বাসনে পাঠাতে পারে। ঝলসানোর হাত থেকে রক্ষা পেতেই তো ডায়ানার শেষ সংলাপ ছিল, লিভ মি অ্যালন (আমাকে একা থাকতে দাও)।

একা না থেকে দোকা অর্থাৎ লিটল স্প্যারো এবং মোমনে দুজনে দীর্ঘ দিবা-রঞ্জনী নির্বাসনে পার করে সুরার বোতলে মুখ রেখে। কিন্তু ওই যে বলে ভুল আবহাওয়া সঙ্কেত জানিয়েও বৃষ্টির কথা বলে বসন্তের আগমনকে আটকে রোখা যায় না তেমনি আটকে রাখা যায় না লিটল স্প্যারোকে।

মঞ্চ কাঁপিয়ে গায়কি সরা নিয়ে পুনরায় আগমন ঘটে লিটল স্প্যারোর। তবে এবারে ভিতরের গায়কি সত্তা এক শুধু নামের মুখোশ বদল। লিটল স্প্যারো হয়ে যায়। এডিথ ফিফ। আবার ফ্রান্সের পত্রপত্রিকায় একের পর এক এডিথ ফিফের জয়জয়কার। ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন তথা সমগ্র ইউরোপ এডিথ ফিফের কন্ঠের অমৃতধারায় মুগ্ধ বিস্মিত।

বিস্মিত হয়ে ওঠা দর্শকদের জন্য একজন শিল্পীর কত খাটুনি সেটা যেমন লা ডি রোজ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে তেমনি জীবনবোধে বেড়ে ওঠা একজন শিল্পীর জন্য একাডেমিক শিক্ষা কতটুকু প্রয়োজন সেটুকু দেখানো হয়েছে। এডিথ ফিফ স্বভাবকবির মতো স্বভাবগায়িকা। কিন্তু গানের রচয়িতা, সুরকার এবং কম্পোজার রেমন্ড আসো এডিথ ফিফকে বলে অন্য কথা। বলে ক্যাবারে গান গাওয়া আর থিয়েটারের মঞ্চে গাওয়া ভিন্ন কথা।

ক্যাবারে তুমি যেভাবে গাও তা লোকে শুনবে কিন্তু থিয়েটারে দর্শক তোমার কিছু এক্সপ্রেশন, কিছু অনুভূতির প্রকাশ চাইবে। এই যে তোমার সুন্দর দুটি হাত। সেই হাত দুটির ব্যবহার করো। গানে ডাকার আহ্বান থাকলে হাত দিয়ে ডাকো। গানের কথা যন্ত্রণা থাকলে মুখাবয়বে যন্ত্রণার, জিঘাংসার, বেদনার অভিব্যক্তি তোলো।

মনের বিপক্ষে একাডেমিক কলাকৌশল রপ্ত করে মঞ্চ সফল গান পরিবেশন করলেও একজন সাহিত্যিক কিংবা গায়ক-গায়িকার জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতাই যে তার শিল্প নির্মাণে প্রভূত সহায়ক সেটা প্রমাণিত হয় নিউইয়র্কে। বর্তমান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নামে নামাঙ্কিত মঞ্চে গাওয়া গান শোনে নিউইয়র্কবাসী।

নিউইয়র্কে এসে এডিথ ফিফের সঙ্গে পরিচয় হয় ফ্রান্সের অন্যতম বক্সার মার্সেল সারডানের। মার্সেল সারডান যেমন উঁচু-লম্বা তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত ও মার্জিত। একজন মেয়ে যেসব কারণে একজন পুরুষকে পছন্দ করতে পারে সেসব কারণই বর্তমান মার্সেলের মধ্যে। এডিথ ফিফ যখন জিজ্ঞাসা করে সব লোক তোমাকে দেখছে কিন্তু কেন? মার্সেল বলে, গতকাল টিভির মাধ্যমে সবাই দেখেছে কি পরিমাণ বক্সিংয়ে মার খেয়েছি। মার যে খেয়েছি সেটাই তারা বলাবলি করছে।

এডিথ ফিফ একজন মেয়ে হয়ে ভাবে, যেখানে ছেলেরা নায়ক হওয়ার জন্য নিত্যনতুন বানোয়াট বীরোচিত গল্প ফাদে সেখানে মার্সেল সত্যি কথা সহজভাবে বলছে। যদিও তারা দুজনেই এখন নিউইয়র্কে কিন্তু তারা দশ-বারোটা দোকান খুঁজে অর্ডার দিয়েছে একই ফ্রান্সের খাবার। অর্থাৎ দুজনের পছন্দের রুচি প্রায় একই রকম। এডিথ ফিফ বলে, বক্সিং মৌসুম শেষ হলে কি করো? মার্সেল বলে, গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শুকরের চাষ করি। এডিথ ফিঞ্চ বলে, তোমার অবর্তমানে তোমার থামার কে

দেখে? মার্সেল বলে, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তান। স্ত্রীর প্রসঙ্গ শুনে এডিথ ফিফের গলায় হঠাৎ ভাত আটকে যাওয়ার দশা হলেও তখন এডিথ ফিফ উপলব্ধি করে ততক্ষণে সে মার্সেল সারডানকে ভালোবেসে ফেলেছে। এডিথ ফিফের পক্ষে তখন আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।

কারণ একজন মেয়ের কাছে ভালোবাসা অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে নামা সৈন্যদের মতো অবস্থা, হয় মৃত্যু নচেৎ জয়। মার্সেল বৃষ্টিভেজা রাতে এডিথ ফিফকে নিয়ে নিউইয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটে আর সোডিয়াম লাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয় দুজন দুজনের কাছে। সিদ্ধান্ত হয় এফ কেনেডি হলে এডিথ ফিফের গান শুনতে আসবে মার্সেল আর মার্সেলের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন বক্সিং দেখতে যাবে এডিথ ফিফ এফ কেনেডি হলের দর্শক আসনে সামনের দিকটায় বসা মার্সেল।

পর্দা সরলে টপ অ্যাঙ্গেল আলোয় মঞ্চে দাঁড়ানো এডিথ ফিফ। নীলনয়না এডিথের চোখ তামাম দর্শকের মধ্যে খুঁজে ফিরছে তার আত্মার আত্মা মার্সেলকে। আকাশের হাজার তারার মাঝে যেমন অনুরাগীর পক্ষে ধ্রুবতারা খুঁজে নিতে কষ্ট হয় না তেমনি চোখ দিয়ে দেখে খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না মার্সেলকে। মার্সেলের চোখে চোখ রেখে, ভালোবাসা উজাড় করে গেয়ে ওঠে এডিথ ফিফ তার আত্মার ভালোবাসা লা ভি অ রোজ গান।

চোখের ওই ভাষায় আমার প্রথম প্রেম ঠোঁটের ওই হাসি আমার শিহরণ তোমার মুখাবয়ব আমার মানসলোক তুমি আমি আজ তাই মিলেমিশে একাকার। তখনই হলাম রঙিন সাতটি রঙে। আমি প্রথম যখন তোমার বাহুর বন্ধনে প্রথম আলোড়িত যখন তোমার স্পর্শে তখনই হলাম রঙিন সাতটি রঙে।

ভালোবাসার যে কথা তুমি বলেছিলে সারা দিন সারা রাত যা বেজেছিল কানে সব রং দিয়ে আমায় রাঙিয়েছিলে কুয়াশার ঘোরে মন তুমি বেঁধেছিলে তখনই হলাম রঙিন সাতটি রঙে।

কল্পনার মনোভূমে বিষয়কে স্পষ্টভাবে দেখে এডিথ ফিফের যে অমৃতবর্ষণ তা দেখে উপস্থিত দর্শকের মুহুর্মুহু করতালি। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন বক্সিং গেমে একইভাবে এডিথ ফিফ উপস্থিত থেকে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে মার্সেলকে উদ্দীপ্ত করে বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়নের খেতাব জয় করে।

রাতের আঁধারে ফুলের বিছানায় দুই বিশ্বজয়ী সমুদ্রসঙ্গমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। একসময় মার্সেল ফ্রান্সে ফিরে যায়। এডিথ ফিফ থেকে যায় নিউইয়র্কে নিউইয়র্কের প্রথম সারির পত্রপত্রিকায় তখন বড় বড় শিরোনাম – এডিথ ফিফের কন্ঠের ইন্দ্রজালে গোটা নিউইয়র্কবাসী। প্যারিসের পরা এডিথ ফিফ কিংবা ফ্রান্সের আত্মার কন্ঠস্বর এডিথ ফিফ।

এডিথ ফিফ হোক কিংবা অলিগলির কোনো এক সাধারণ মানুষ হোক, পড়ন্তবেলায় যে কারোরই স্মৃতিচারণ সাইক্লিক অর্ডারে হয় না। হয় আগে পড়ে। দেখা গেল সি-এর পর পি কিংবা ইউ-এর পর ডি। ফলে পরিচালক অলিভার ডাহানকে অনেক ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য যেমন দেখাতে হয়েছে তেমনি ফ্ল্যাশ ফরওয়ার্ড দৃশ্যও দেখাতে হয়েছে।

মনও হয়েছে এডিথ ফিফ স্মৃতিচারণায় চলে গেছে ১৯৩০ সালে, আবার সেখান থেকে রওনা দিয়েছে ১৯৫০ সালে, আবার সেখান থেকে ১৯৪০ সালে। এ রকম একটি ক্ষেত্রে এডিথ ফিফ তার ভালোবাসার মানুষ মার্সেলের উদ্দেশে নিউইয়র্কে বসে লিখছে, আমি জানি তোমার প্রতি আমার যে গভীর ভালোবাসা, তোমার সেই গভীর ভালোবাসা তোমার স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি।

তোমার ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি আমাকে তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে নেবো। আমি নিশ্চিত, আমার এ দূরে নিজেকে নিজে সরিয়ে নেয়ার কারণে তুমি আমার প্রতি এক সময় কৃতজ্ঞতা বোধ করবে। কিন্তু আমি যতদূরেই যেতে চাই না কেন আমি কিছুতেই তোমার থেকে ভিন্ন হতে পারি না। যেহেতু এ জীবনে আমি ঈশ্বরের কাছে নিজের জন্য কিছুই চাইতে পারিনি। ফলে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটানো ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

যদি আমি নিজেকে তোমার থেকে দূরে সরিয়েও নিই কিংবা তুমি যদি আমার থেকে দূরে সরেও যাও তবু তোমার-আমার ভালোবাসা যে অটুট ছিল সে রকম অটুট থাকবে এবং তোমা ভিন্ন আমার বেঁচে থাকার নাম হবে মৃত্যু।

মৃত্যু যে কোথায় কার কখন হবে তা আগে থেকে বলা যায় না। তবু একজন প্রেমিকা তো চায় তার সর্বোচ্চ ভালোটা তার প্রেমিককে উজাড় করে দিতে। পরের রাতে নিউইয়র্কে বড় হলরুমে বেশিসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে এভিন্ন ফিফের গানের সন্ধ্যা। এত বড় বড় শো হবে অথচ দর্শকাসনে মার্সেল থাকবে না তবে কার জন্য এ গান গাওয়া। এডিথ ফিফ টেলিফোনে কল করে ফ্রান্সে থাকা মার্সেলকে সোনা জাদু, তুমি শেষবারের

মতো আমার কথা রাখো। আজ রাতের ফ্লাইটে চড়ে তুমি নিউইয়র্কে আসো। না না, আমি কোনো কথাই শুনবো না। আমি তোমাকে মঞ্চের সামনে দেখবো, তোমার চোখের ভাষার আহ্বানে সাড়া দিতেই আমি গান গাইবো। তুমি জানো না, তোমার উপস্থিতিতে গান গাইতে পারাটা একজন মেয়ে হয়ে আমার জন্য কত গর্বের। লক্ষ্মীটি এখনই ফোন রেখে তুমি ফ্লাইট বুকিং করো। আজ সারা রাত আমি ঘরের দরজা খুলে রেখে ঘুমাবো, যাতে তুমি ভোরে সোজা আমার বেডরুমে চলে আসতে পারো।

ভোরে ঘরে ঢোকে মার্সেল। ঘুম ভেঙে মার্সেলের মিষ্টিমুখ দেখে পরম মমতায় আদরে আদরে এডিথ ফিফ ভরিয়ে তোলে মার্সেলকে। মার্সেলকে বসিয়ে রেখে কফি বানিয়ে আনে, দুজনে কফি খায়। মার্সেলের জন্য উপহারস্বরূপ সোনার ঘড়িটি খুঁজতে গিয়ে দেখে সমস্ত বাড়ি সবাই নিশ্চুপ।

সবাই কেন চুপ বার বার জিজ্ঞাসা করার পর বয়স্ক প্রযোজক এডিথ ফিফকে বলে, এডিথ তোমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। গত রাতে নিউইয়র্কগামী ফ্রান্সের বিমান ক্র্যাশ করে পাইলট, ক্রু, প্যাসেঞ্জার সবাই মারা গেছে। মার্সেলও মারা গেছে। নো ইউ স্টুপিড ব্লাডি, মার্সেল উইল নেভার ডাই বিফোর মি. মার্সেল ইন মাই রুম নো (বোকা বদমাশ, মার্সেল কখনই আমার আগে মারা যাবে না। মার্সেল আমার ঘরে)।

এডিথ ফিফ দৌড়ে ঘরে গিয়ে দেখে না, কেউ নেই ঘরে। বাড়ির সব ঘরে দৌড় লাগায় কিন্তু কোথাও নেই মার্সেল। তবে কি বিমান ক্র্যাশের কথা যা বললো তাই সত্যি? আহা রে, এ আমি কী করলাম। আমিই আমার মার্সেলকে আসতে বলে মেরে ফেললাম। এখানে পরিচালক একটা চমৎকার মন্তাজ শট উপহার দিয়েছেন দর্শকদের জন্য।

শোকে বিলাপ করা এডিথ ফিফ কাদতে কাদতে সরাসরি পৌঁছে গেছে মঞ্চে এবং গাইছে করুণ গান। মন্তাজ শটের মধ্য দিয়ে পরিচালক অলিভার ডাহান যেন বোঝাতে চাইছেন, একজন শিল্পীর যে উচ্ছ্বাস কিংবা যে বেদনা লাখ লাখ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে সেই বেদনা বা উচ্ছ্বাসের প্রেরণা থাকে শিল্পীর ঘটনাময় ঘটে যাওয়া জীবনে।

ধার করে পণ্ডিত হওয়া যায়, হওয়া যায় না। জ্ঞানী জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও এডিথ ফিফ বার বার দেখা করে মার্সেলের স্ত্রীর সঙ্গে। মার্সেলের স্ত্রী বলে, এডিথ এ নিয়ে তুমি তিনবার এলে এক সপ্তাহের মধ্যে। আমার যা বলার তা আমি বলে দিয়েছি। মার্সেল মারা গেছে। এর বাইরে আর কী জানার বাকি থাকতে পারে? প্রতিউত্তরে এডিথ ফিফ বলে, আমার জানার দরকার আমি কোথায় গেলে তাকে পাবো। তার বিমান ক্র্যাশ করেছে বাতাসে। সে বাতাসে মিশে কোথাও না কোথাও আছে। সে সত্যিই এসেছিল আমার ঘরে।

ঘরে আর মন ধরে না এডিথ ফিফের। মার্সেলবিহীন এডিথের জীবন শূন্য। নিজের পছন্দের কুঁকড়ানো চুল নিজেই কেটে ফেলে। এই সুশ্রী যার জন্য সেই যখন নেই তখন আর কার জন্য এই ভালো থাকা। মানুষ মাত্রই অবলম্বন ছাড়া বাঁচতে পারে না। বাঁচার অবলম্বন হিসেবে হাতে তুলে নেয়। কোকেন আর মরফিন। এডিথ ফিফের তখন একটাই চাওয়া- যত দ্রুত সম্ভব মরে বেঁচে যাওয়া।

চলচ্চিত্রের শেষের দিকটায় দেখা যায়, নিউইয়র্কের এডিথ ফিফের শেষ দিনগুলোতে এডিথ ফিফ সমুদ্রের পাশে বসে বহমান স্রোতধারা দেখে উল দিয়ে একটা সোয়েটার বুনছে। তেমনি এক পড়ন্ত বিকালে সুদূর ফ্রান্স থেকে এক রিপোর্টার ভদ্রমহিলা আসে এডিথ ফিফের সাক্ষাৎকার নিতে।

রিপোর্টার ভদ্রমহিলা বলে, আমি সেই অনেক দূরের ফ্রান্স থেকে এসেছি। এডিথ ফিফ বলে, আমি তো এক মুহূর্তের জন্য কোনোদিন ফ্রান্স থেকে দূরে নেই। রিপোর্টার প্রশ্ন করে, আপনার প্রিয় রং? উত্তর নীল। সেরা খাবার? উত্তর গোমাংসের রোস্ট। আপনি কি সহনশীলতা পছন্দ করতেন?

উত্তর- সেভাবেই তো বেলা পার করলাম। আপনার আদর্শের বন্ধু কারা। উত্তর—প্রকৃতই বন্ধু যারা। রিপোর্টার এবার বিশেষ বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, যদি কোনোদিন আপনার গান থেমে যায়! তৎক্ষণাৎ উত্তর- গান থামলে আমার জীবনও থেমে যাবে।

প্রশ্ন—আপনি কি মৃত্যুভয়ে ভীত? উত্তর- তার চেয়ে বড় ভীত যদি কখনো একা হয়ে যাই। প্রশ্ন — আপনি কী প্রার্থনা করেন? উত্তর – মানুষ মানুষকে ভালোবাসুক। প্রশ্ন— গান মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে সব থেকে ভালোলাগার সময় কখন? উত্তর- যখন আমার আর দর্শকদের মাঝের পর্দা আস্তে আস্তে উঠে যায়।

প্রশ্ন—নারী হিসেবে সব থেকে ভালোলাগার মুহূর্ত । উত্তর—প্রথম চুম্বন। প্রশ্ন- আপনার কি রাত পছন্দ? উত্তর – অবশ্যই, তারা ঝলমল আলোকিত রাত। প্রশ্ন— প্রভাত কীভাবে শুরু করতে ভালো লাগে? উত্তর–পিয়ানো বাজিয়ে আর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিয়ে। প্রশ্ন—আর সন্ধ্যা?

উত্তর- সেটা তো আমাদের জন্য সব সময়ের সকাল। প্রশ্ন- একজন ভদ্রমহিলার জন্য আপনার কি উপদেশ? উত্তর- ভালোবাসো। প্রশ্ন একজন তরুণীর জন্য আপনার কী উপদেশ? উত্তর – ভালোবাসো। প্রশ্ন- একজন শিশুর জন্য আপনার কী উপদেশ? উত্তর – ভালোবাসো।

রিপোর্টার ভদ্রমহিলা বলছে, ম্যাডাম এডিথ ফিফ, আপনার কাছে সর্বশেষ প্রশ্ন—এই যে আপনি সোয়েটারটি বুনছেন এটি কার জন্য? সমুদ্রের বহমান স্রোতধারায় চোখ ভাসিয়ে প্যারিসের আত্মার কণ্ঠস্বর এডিথ ফিফ উত্তর দেন, যে কারো জন্য, যে এই সোয়েটারটি পরবে তার জন্য।

এডিথ ফিফের বোনা সোয়েটার এক অর্থে রূপক। সোয়েটার এখানে এডিথ ফিফের সারা জনমের কর্মের জলাধার। যে কোনো অনুরাগী মাত্র সেই জলাধারের অমৃত জল পান করে পিপাসারূপ মনের তৃষ্ণা নিবৃত্ত করে দুদণ্ড শান্ত হতে পারেন। এডিথ ফিফ মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১০ অক্টোবর ১৯৬৩ সালে মারা যান।

প্যারিসের যে রাস্তার পাশে এডিথ ফিফ চিরনিদ্রায় শায়িত সেখানে সারা বিশ্ব থেকে ছুটে আসা তার অনুরাগী ভক্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে বহু আগে। এডিথ ফিফের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তামাম বিশ্বের মানুষের কাছে এডিথ ফিফকে নতুন করে জানিয়ে দিতে ফ্রান্সের পরিচালক অলিভার ডাহান যে আন্তরিক প্রচেষ্টায় নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘লা ভি অ রোজ তা এক কথায় অভূতপূর্ব।

কোটি কোটি দর্শকের ভালোবাসার পাশাপাশি ২০০৮ সালে অস্কার প্রতিযোগিতায় সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পুরস্কার এবং মেকআপে অস্কার জিতে নিয়েছে অলিভার ডাহান চলচ্চিত্র লা ভি অ রোজ। পরিচালকের স্থির বিশ্বাস — মানুষের এ নশ্বর দেহ একদিন না একদিন চলেই যায়।

 

লা ভি অঁ রোজ 

 

কিন্তু রয়ে যায় তার কর্ম। এডিথ ফিক সশরীরে আজ আর নেই কিন্তু তার গেয়ে যাওয়া গান আজো ভেসে বেড়াচ্ছে নবপ্রজন্মের গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে। এডিথ ফিফের গানই যে শেষ পর্যন্ত এডিথ ফিফকে বাঁচিয়ে রাখবে সেটা বুঝিয়েই লা ভি অ রোজ চলচ্চিত্র শেষ করেছেন। পরিচালক অলিভার ডাহান। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে এডিথ ফিফ তার সেবিকাকে ডেকে বলেছেন, আমি আর কোনোভাবেই আমার আগের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারছি না। মনে ভাসছে শুধু ওলিম্পিয়া মঞ্চে গাওয়া সেই গান—

না… না… না, কোনো কিছুই কিছু না

ভাবি শুরু করি আজ নবসাজে

যে জীবনে আমি আপনাদের সঙ্গে

সেটুকুই হোক জীবন ধারণ

আর কিছুই কিছু না….

না… না… না… কোনো কিছুই কিছু না…।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment