মার্টিস ওয়ার্ল্ড 

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ মার্টিস ওয়ার্ল্ড  ।

মার্টিস ওয়ার্ল্ড

 

মার্টিস ওয়ার্ল্ড 

 

মার্টিস ওয়ার্ল্ড

চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ :

হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকা এক বৃদ্ধের সাথে ক্যান্সার আক্রান্ত এক শিশুর মর্মস্পর্শী সম্পর্ক এবং সহস্র প্রতিকূলতার বিপরীতে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ে এগিয়ে চলা।

দেশ                  : ফ্রান্স

পরিচালক        : ডেনিস বরদিআও

লেখক              : ডেনিস বরদিআও

                           অ্যালেকজান্দ্রে জাে

রিলিজ ডেট     : ২৬ জানুয়ারি ২০০

মুখ্য চরিত্র        : মাইকেল সেরাউন্ট

                          জোনাথান ডেমুরজার

মার্টিস ওয়ার্ল্ড

সংসারে আক্ষেপ করে অনেককেই বলতে শোনা যায়, নবীন প্রজনের কাছে বয়োজ্যেষ্ঠরা ব্যাকডেটেড কিংবা চিন্তা-চেতনার হিসাবের খাতায় বাতিল। অপরদিকে বয়োজ্যেষ্ঠদের দৃষ্টিতে নবীন প্রজন্ম ইচড়ে পাকা কিংবা অতিবোদ্ধা।

কিন্তু দাদা-দাদী এবং নাতি-নাতনীর মধ্যকার যে মধুর সম্পর্ক সেই সম্পর্ক কেন যে তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না সে কথাই বার বার মনে হচ্ছিল ফ্রেঞ্চ চলচ্চিত্রকার ডেনিস বরনিআও-এর ক্লাসিক চলচ্চিত্র ‘মার্টিস ওয়ার্ল্ড” দেখতে দেখতে।

ক্যান্সার হাসপাতালে অসাড় হয়ে পড়ে থাকা সত্তরোর্ধ অ্যান্টনি বেরান্ট এবং দশ বছর বয়সী সদ্য ক্যান্সার-আক্রান্ত মার্টির মধ্যেকার যে মর্মস্পর্শী সম্পর্ক এবং শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাঁচার যে শিশুসুলভ চেষ্টা সেই প্রেক্ষাপট নিয়েই চলচ্চিত্র মার্টিস ওয়ার্ল্ড।

চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় হাসপাতালের কেবিনে মার্টিসের ব্লাড চেকআপ শেষ হয়েছে যেখান থেকে ডাক্তার মার্টিসের মাকে আশ্বস্ত করছে এই বলে যে, আপনার সন্তানের অবস্থা পুরোপুরি বোঝা যাবে সামনের সপ্তাহে পুনঃএকটা টেস্টের পরে।

তবে আপাত আমরা সব রকম সহযোগিতা মার্টিসের কাছ থেকে পেয়েছি। আসলে কি একটা যাত্রী এবং মালামাল বোঝাই জাহাজ যতই আবহাওয়া এবং স্রোতের অনুকূলে থাকুক না কেন মূল প্রশ্ন জাহাজের তেল নিয়ে। জাহাজের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের পক্ষে করণীয় খুব কমই থাকে।

তেমনি মার্টিসের জ্বালানি তথা প্রাণশক্তি এখন রক্ত। রক্তে ক্যান্সার বাসা বাঁধলে রোগী এবং ডাক্তারের পক্ষে করণীয় তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ট্রান্সপারেন্সি গ্লাসের মধ্য দিয়ে মা এবং ডাক্তারের কথোপকথন অনুমান করে শিশু মার্টিসের দৃপ্ত সংলাপ, ভবিতব্য নিয়ে বলার সময় এখন না।

শিশু মার্টিস যেভাবে ভয়কে রুখতে জানে তেমনটা পারেন না হাসপাতালে বিছানায় সমস্ত দেহ অসাড় হয়ে পড়ে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ অ্যান্টনি বেরান্ট। হাত-পা কোমড় সবই তার অচল সচল শুধু এক জোড়া চোখ এবং মস্তিষ্কের সামান্য অংশ। মস্তিষ্কের সেই অংশে শুধু মনে পড়ে তার নাম

অ্যান্টনি বেরান্ট। সে জন্মেছে ১৯২৬ সালে। মাসটা আগস্ট নিশ্চিত হলেও জন্মদিন ৭ আগস্ট কিনা তা পুরোপুরি স্মৃতিতে ভাসে না। তবে তার স্ত্রীর নাম যে সুজান বেরান্ট এটা পুরোপুরি ঠিক মনে আসে। বার্ধক্যে স্বামীর কাছে স্ত্রী এবং স্ত্রীর কাছে স্বামী যে কত আপন সেটা বোঝা যায় বার বার স্মৃতি বিভ্রাটের মধ্যেও স্ত্রীর নাম মনে করতে পারায়।

তবু এই স্মৃতি বিভ্রমের মধ্যেও ডাক্তার রোগী অ্যান্টনি বেরান্টকে আশ্বস্ত করে তিনটি কথা বলে। স্মৃতিবিভ্রম যে আনন্দের তার কারণ অতীতের কোনো বাজে স্মৃতি মনে পড়বে না, এখন নতুন যাকে দেখবেন সেই আপনার বন্ধু এবং প্রতি মুহূর্তেই আপনার নবজনা, কারণ পুরো অতীতটাই আপনার কাছে মৃত।

মৃত্যু যতই কাছে আসুক শিশু মার্টিস কিছুতেই দমার পাত্র নয়। হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ড, পুরুষ ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড আলাদা থাকলেও শিশু মাটিসের যাতায়াত সব ওয়ার্ডে সাবলীল। হাসপাতালে বিশ্রামের জন্য যে রোগী ভর্তি করানো হয় সে কথা মার্টিসকে কে বোঝায়।

মার্টিসের কাছে পুরো হাসপাতালটাই যেন ফুটবল খেলার মাঠ। প্রতিটি কেবিন পর্যবেক্ষণ করা যেন তার মুখ্য গবেষণা। এভাবে এক সময় ৪০৯ নম্বর কেবিনে সে আবিষ্কার করে অ্যান্টনি বেরান্টকে। অ্যান্টনি বেরান্টকে দেখার পর থেকে এক তীব্র টান অনুভব করে মার্টিস। যেন জনম জনম পরিচয় অ্যান্টনি বেরান্টের সাথে।

অ্যান্টনি বেরান্ট যতই বোঝাতে চায় মার্টিস তুমি আমার কেউ নও, না বন্ধু না নাতি তবু মাটিস নাছোড়বান্দা। মার্টিসের মা মার্টিসকে বোঝায় তিনি অসুস্থ, তার বিশ্রাম দরকার তবু মার্টিস কথা শোনে না। মার্টিস তার মাকে বলে, হয়তো তিনি আমার কেউ না, হয়তো তিনি আমার কারণে অসুস্থ থেকে আরো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন তথাপি আমি তার কাছে থাকবো।

কারণ তিনি আমার চঞ্চলতাকে অনুমোদন করেন, তিনি আমার খেলার মানসিকতাকে স্বাগত জানান এবং সর্বোপরি অজানাকে জানার ব্যাপারে আমরা দুজনেই কৌতূহলী। শিশু মাটিসের এই বিশ্লেষণে দর্শক অবাক না হয়ে পারে না।

অবাক যথারীতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, নার্স ডাক্তার সবাই। পুরুষ ওয়ার্ডের ডাক্তার এবং শিশু ওয়ার্ডের ডাক্তাররা যতই আইনি কথা বলুক না কেন নানু নাতির এই মধ্যকার টানকে কারো পক্ষে উপেক্ষা করা চলে না। অবশেষে ৪০৯ নম্বর কেবিনে অ্যান্টনি বেরান্টের বিছানার পাশে নতুন বিছানা পোতা হয় মার্টিসের জন্য।

দুই বিছানায় দাদু নাতী বাসী দুটি মানুষের মুখোমুখি টপ অ্যাঙ্গেল ক্লোজ শটে পরিচালক অ্যালাইন আরপুর যেন বললেন,দাদু-নাতির এই মধুর সম্পর্ক আজীবনের সত্য। এটা ছিল এবং থাকবে আজীবন। এই মধুর সম্পর্ক যেখানেই প্রকাশ পাক না কেন সেই জায়গাও জ্যোতির্ময়। যেমন হাসপাতালের এই কেবিন শুধু এখন রোগীর জন্যে নয়। বরং এটা এক আনন্দ আশ্রম।

 

মার্টিস ওয়ার্ল্ড 

 

মার্টিস হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে ফুটবল খেলে, টেলিভিশনের পর্দায় ক্লাসিক চলচ্চিত্র দেখে এবং বালি খুড়ে জল তোলার মতো করে বৃদ্ধ অ্যান্টনির বায়োগ্রাফি দেখে তার অতীতকে চিনতে চায় এবং অ্যান্টনিকে চেনাতে চায় মাটিস নিশ্চিত হয় অ্যান্টনি প্রকৃতপক্ষে পেশায় ছিলেন রাষ্ট্রীয় গোপন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মী।

রহস্য উদ্ঘাটন করাই যে গোয়েন্দার কাজ এবং তারও পছন্দ আবিষ্কার করা— এটা ভেবে মাটিস আনন্দিত হয়। কারণ উভয়েই তারা আবিষ্কারক। মাটিস তার কেবিনে সব রোগীকে একত্রিত করে ছবি তোলে। পারিবারিক বন্ধন পেয়ে সবাই তৃপ্ত।

সপ্তাহ শেষ হয়। মার্টিসকে চেকআপ করতে নেয়া হয়। কেবিন শূন্য ঘরে অ্যান্টনি বেরান্ট দূরদিগন্তে চোখ ভাসিয়ে নিথর হয়ে বসে থাকে। কি যেন নেই, কে যেন নেই, নিঃসঙ্গতা গাঢ়ভাবে চেপে ধরে অ্যান্টনি বেরান্টকে। ল্যাবরেটরির চেকআপে ডাক্তারের চোখ বিষয়।

ডাক্তারের হার্টবিট দ্রুত বেড়ে যায়। মার্টিসের মাকে ডাক্তার বলে রেজান্ট অপ্রত্যাশিত। মার্টিসের জীবন বিপন্ন। হয়তো এক মাস কিংবা এক সপ্তাহ অথবা যে কোনো সময় যে-কোনো মুহূর্ত। মার্টিসের মায়ের চোখ জলে ভিজে উঠলে ট্রান্সপারেন্সি গ্লাসের ভিতর থেকে সব দেখে মাটিসের পুনঃদৃপ্ত সংলাপ, ডাক্তার আপনার বিবেচনা ভুল । কারণ আপনি জানেন না মাটিস কখনোই হারে না, কারণ সে যোদ্ধা এবং যুদ্ধ করতে জানে।

রাতে কেবিনে ফিরে মার্টিস অ্যান্টনিকে বড়দিনের গিফট দেয় একটা চাবি। বলে এই হাসপাতালে থাকার অর্থ দ্রুত মৃত্যুকে আহ্বান করা। মৃত্যু যে কারো যে কোনো সময় হতে পারে। আমাদের মৃত্যু যখন নিশ্চিত তাহলে ভয় পেয়ে আর লাভ নেই। যতক্ষণ বাঁচবো প্রাণভরে বাঁচি। বাঁচি বাঁচার আনন্দে ।

সে রাতেই মার্টিস অ্যান্টনি বেরান্টকে হুইল চেয়ারে নিয়ে হাসপাতালের কারাগার থেকে পালায়। পালানোর পথে অ্যান্টনির কর্মজীবনের গোপন গোয়েন্দা সংস্থা ঘুরে যায়। সবার উদ্দেশে মাটিস বলে, এই অ্যান্টনি বেরাল্টের কারণে আমাদের দেশে অনেক বড় বড় নাশকতা ব্যর্থ হয়েছে। এবার রোগও ব্যর্থ হবে। আমরা দুজনেই হারতে জানি না। গোয়েন্দা সংস্থার সব কর্মী সমস্বরে করতালিতে হলরুম ভরিয়ে তোলে।

চলচ্চিত্রের শেষে দেখা যায় সমুদ্রের বালির মধ্য দিয়ে হুইল চেয়ারে বসা অ্যান্টনি ব্রোন্টকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে এগিয়ে চলছে মার্টিস। সমুদ্রের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মার্টিস বলে, আমার দানী বলেন, এই পৃথিবীর যা কিছু সঞ্চয় তা এই বালির উপর ঘর বাধার মতো। এই আছে এই নেই।

কিন্তু স্বর্গরাজ্যে ঘর বাধলে, তা না ভাসে না ভাঙে। তাই আমার ইচ্ছা স্বর্গরাজ্যে ঘর বাধার। সব সময়ের সর্বক্ষণের চিন্তা আমার সেটা। কিন্তু আমার না আছে সেই স্বর্গরাজ্যে যাওয়ার পাসপোর্ট, না আছে স্বর্গরাজ্যে একখণ্ড জমি। শিশু মার্টিসের সরল বিশ্বাস এবং ডাক্তারি রিপোর্ট মতে সম্ভাব্য ভবিতব্য ভেবে অ্যান্টনি বেরান্টের চোখ ভেসে যায় জলে।

অ্যান্টনি বেরান্ট তার পকেটে থাকা একটি প্যাকেট দেয় মার্টিসকে। হুইলে করা সব সম্পত্তি মার্টিসকে দেন চিকিৎসার জন্য। একটি ধর্মীয় পুস্তক দেন যেটি স্বর্গরাজ্যের পাসপোর্ট। আনন্দে আপ্লুত মার্টিস যখন অ্যান্টনি বেরান্টকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমরা রক্তের সম্পর্কে বাধা নই তবু আমার জীবনে আপনি সেরা মানুষ এবং আমার সেরা দাদু।

 

মার্টিস ওয়ার্ল্ড 

 

প্রতি উত্তরে কাঁদতে থাকা দাদু বলে, মার্টিস তুমি কথা দাও আমি থাকি কিংবা না থাকি তুমি বাঁচবে— লড়াই, যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কথা দাও। নিরুত্তর দাদুর বুকে নাতি। বড় পর্দায় হুইল চেয়ারে বসা দাদুর পাশ দিয়ে সমুদ্রের জল দূর থেকে দূরে বয়ে চলে যেভাবে ধাবমান জীবনে এগিয়ে চলে সম্মুখ থেকে সমুদ্রে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment