ফোর মিনিটস 

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ ফোর মিনিটস  ।

ফোর মিনিটস

 

ফোর মিনিটস 

 

ফোর মিনিটস

চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ :

ভালো মানুষ যে শেষ পর্যন্ত মন্দের মাঝে ভালোকে খুঁজে পায় এবং ভালোর স্পর্শে মন্দও যে ভালো হয়ে যায় সেই প্রেক্ষাপটে এক শিক্ষিকা ও ছাত্রীর কাহিনী।

 

দেশ                             : জার্মানি

পরিচালক                    : ক্রিস ক্রস

লেখক                         : ক্রিস ক্রস

 

রিলিজ ডেট                : ১৮ এপ্রিল ২০০৮

মুখ্য চরিত্র                   : মনিকা বিলিবটরিও

                                      হানা হারজ প্রাঙ্গ

                                      সিডেন পিপ

                                      রিচি মুলার

ফোর মিনিটস

একজন মানুষ কিভাবে ধীরে ধীরে অপরাধী হয়ে ওঠে সে বিষয়ে একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ভালো বলতে পারলেও প্রকৃত সত্য হলো জগৎসভায় একজন ভালো মানুষ যেভাবে আদরণীয় মন্দ মানুষ সে রকম নন।

কিন্তু হাজার বছরের অন্ধকারের ঘরে একটি মাত্র দেশলাইয়ের খোঁচায় যেমন সমস্ত অন্ধকার নিমিষে হারিয়ে যায়, আঁধার ঘর আলোকিত হয়ে ওঠে তেমনি একজন প্রচলিত মন্দ মানুষ যে সৎ সজ্জন মানুষের সাহচর্যে ভালো হয়ে উঠতে পারে সে কথাই বার বার মনে হচ্ছিল প্রায় ত্রিশের অধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত জার্মান পরিচালক ক্রিস ক্রসের চলচ্চিত্র ফোর মিনিটস’ দেখতে দেখতে।

একজন পিয়ানিস্ট টিচারের সংস্পর্শে এসে খুনের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি কিভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, একজন মানুষের অপরাধী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সে নিজে কতটা দায়ী এবং প্রকৃত সহানুভূতি পেলে মন্দ পথযাত্রীর যে কারো পক্ষেই যে সংশোধিত হয়ে ওঠা সম্ভব সেই সব সামগ্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে রোমাঞ্চকর, নাটকীয় এবং দ্বন্দ্বমুখর চলচ্চিত্র ফোর মিনিটস।

ফোর মিনিটস হোক আর হানড্রেড মিনিটস হোক চলচ্চিত্রের শুরুতে মহিলা কয়েদখানার মহিলা কয়েদি জেনি ভন লোবেনের (হানা হার্জ প্রাং) কয়েদি জীবনের সময় যেন কিছুতেই পার হয় না। অন্য মেয়ে কয়েদিরা বাস্কেট বল খেলছে জেনি খেলছে না। অন্যেরা টেবিল টেনিস খেলছে জেনি খেলছে না।

আট দশজনের কয়েদি টিম সরল সোজা কোনো এক কয়েদিকে খুঁজছে যাকে সময় সুযোগ মতো জেলারদের নজর এড়িয়ে উত্তম মধ্যম দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করা যায়। কিন্তু এসবেরই কিছুই ভালো লাগে না জেনির।

কয়েদখানায় থাকলেও জার্মান জেনির দৈহিক বীরত্ব দেখে বোঝা যায় সে তার নিজের জগতের সম্রাজ্ঞী যেখানে সঙ্গী কারোরই প্রবেশ নিষেধ। শাস্তি ভোগ করছে জেনি ঠিকই তবু সে না অপরাধবোধে অনুতপ্ত, না হওয়ার কোনো লক্ষণ আছে।

এসবের বাইরেও নীলনয়না জেনির চোখের অতলে যেন লুকিয়ে অবাধ্য এবং চির চঞ্চল শিশু যে যা করার তাই করে, কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছা তার কাছে মূল্যহীন।। জেনির কাছে যা মূল্যহীন তাই মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় কয়েদখানায় পিয়ানো শিখাতে আসা শিক্ষিকা ট্রেউডি (মনিকা বিউটি)।

গির্জায় সবাই সমবেত লাইনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছে কিন্তু জেনি মনের আনন্দে বসছে দাঁড়াচ্ছে মাথা চুলকাচ্ছে। জেনির নিশ্চিত বিশ্বাস ঈশ্বর যেহেতু তাকে ভালোবাসে ফলে ভালোবেসে আশীর্বাদ ঈশ্বর সব সময় করছেন। অহেতুক সময়ে অসময়ে ডাকাডাকি করে পরম করুণাময়কে সে বিরক্ত করতে পারবে না।

বিরক্ত অন্য কাউকে না করেই টেবিলের উপর পিয়ানোর বিট কল্পনা করে তার উপর দুই হাতের আঙ্গুল চালিয়ে নতুন আসা শিক্ষিকা টেউডি বাজানো পিয়ানোর তালে তালে আপন মনে বাজিয়ে চলে জেনি। টপ অ্যাঙ্গেল ভিউল্লাস থেকে জেনির বাজানোর তাল-লয়-ছল দেখে টিচার ট্রেউডি বা রকেটের গতির সাথে তো সমান ভাবে কোনো ট্যাক্সি যেমন চলতে পারে না তেমনি তার পিয়ানোর সুরের সাথে সমান তালে আঙ্গুল চালিয়ে যাওয়া সামান্য কথা নয়।

সোলজার ক্যান মার্চ উইথ দ্য সোলজার নট দ্য সিভিলিয়ান (সেনা, সেনার সাথে চলতে পারে, বেসামরিকের সাথে না।)। শিক্ষিকা ট্রেউডির দৃঢ় বিশ্বাস জোনি কয়েদি হলেও সে নিশ্চিত অন্য ঘরানার।

ঘরের মধ্যেই শিক্ষিকা নিশ্চিত হয়ে যায় একমাত্র জেনি ছাড়া অন্য কেউই পিয়ানো বাজানোতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। পরিষ্কার-পরিচয় পিয়ানো ধরার আগে হাত ধুয়ে নিতে বলায় ক্ষিপ্ত জেনি গার্ড অফিসার মুটজিকে মেরে শিক্ষিকাকে তাড়িয়ে পিয়ানোর কি-তে হাত চালিয়ে যে সুর তোলে সেই নিগ্রো সুর আর করেন গার্ড অফিসারদের দৌড়ে এসে জেনিকে ধরার চেষ্টা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

জেনির হাতে মার খাওয়া মুটজি খুঁতনিতে আঘাত পেয়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আর গার্ড অফিসারদের মার খেয়ে জ্ঞান হারানো জেনি মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেল্ট দিয়ে ঘাটে বাঁধা। জ্ঞান ফিরে পেয়ে হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করতে থাকা জেনির পাশে শিক্ষিকা ট্রেড বসে বলে, জেনি আমি দুঃখিত।

এমনটা হবে আমি জানতাম না। আমি শুধু এটুকু জেনেছি ঈশ্বর তোমাকে ভালোবেসে পিয়ানো বাজানোর ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস তুমিই জার্মানির সেরা পিয়ানিস্ট। আমি হয়তো তোমায় একজন ভালো মানুষ বানাতে পারবো না কিন্তু ভালো

পিয়ানিস্ট বানাতে পারবো। আমি এটুকু সহযোগিতা তোমাকে করতে চাই। সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ায় জেনি। শিক্ষিকা হিসেবে টেটডি চারটি শর্ত দেয় জেনিকে। প্রথম শর্ত ট্রেউডি যেখানে পিয়ানোর টিচার সেখানে ছাত্রী হিসেবে জেনিকে হতে হবে দাস।

এক সিদ্ধান্তে দুবার ভাবিয়ে পিছনে হাঁটা চলবে না। দ্বিতীয় শর্ত যে হাত পিয়ানোর কি-বোর্ড সুরের ঝংকার তুলবে সেই হাত দু’টিকে জেমির যত্ন নিতে হবে। তৃতীয় শর্ত সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কি-বোর্ডে বসবে তুমি জেনি আর তোমার গা থেকে গন্ধ বেরোবে সেটা হবে না। চতুর্থ এবং ফাইনাল শর্ত আগামী মাসেই অনূর্ধ্ব একুশ বছরের জাতীয় পিয়ানো প্রতিযোগিতা। তাতে তুমি অংশ নেবে এবং তোমার চূড়ান্ত প্রস্তুতির প্রকাশ ঘটাবে। আস্তরিক আহ্বানে তেজী জেনি শেষ পর্যন্ত সব শর্ত মেনে নেয়।

 

ফোর মিনিটস 

 

মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বেঁকে বসে জেলার রিভিউ বোর্ড। তারা বুঝেই উঠতে পারে না যে মেয়ে বুঝেঝ বুঝে একটা মানুষকে হত্যা করেছে, যার হাতের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি সেই মেয়ে জেনি কিভাবে কাঠের পিয়ানোতে সুরের ঢেউ তুলবে।

কিন্তু শিক্ষিকার একটি কথায় জেলার রিভিউ বোর্ড থমকে যায় যখন শিক্ষিকা বলে, মি. মিয়ার বিয়ার, আপনি একবার ভাবুন যখন প্রিন্ট-ইলেকট্রকি মিডিয়ার সাংবাদিকরা আপনার কাছে জানতে চাইবে, একজন কয়েদিকে আপনি কিভাবে জার্মানির সেরা পিয়ানিস্ট বানালেন, উত্তরদানের সেই মুহূর্ত আপনার কেমন লাগবে? জেলার রিভিউ বোর্ড সম্মতি জানায়, আচ্ছা আপনি জেনিকে ট্রেইনআপ করুন।

ট্রেইনআপ করুন ঠিক আছে, কিন্তু কিছুতেই জেনির হাতের হ্যান্ডকাপ খোলা যাবে না। হ্যান্ডকাপ খুললে হয় সে আপনাকে কামড়াবে নচেৎ আমাকে কামড়াবে, নইলে সে নিজেই নিজেকে কামড়াবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কষ্টে অপমান হজম করে কিন্তু কাজ চালিয়ে নিতে থাকে।

এমনই একদিন কারাগার পরিদর্শনে প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা এলে জেলাররা চায় ভালো কিছু উপস্থাপনার জন্য। শিক্ষিকার কাছে অনুরোধ করে জেনিকে দিয়ে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতে। শিক্ষিকা প্রথমে রাজি না হলে জেলারপ্রধান বলে মাত্র চার মিনিট ।

বিশেষ অনুরোধ মাত্র চার মিনিট সে বাজাক। বদলা নেয় জেনি। মুক্ত হাতে সে বাজাবে না। জেলারকে দিয়ে পিছন দিকে হাতে লকআপ পরে পিয়ানো বাজিয়ে পরদিন যে জার্মানির জাতীয় প্রধান প্রধান পত্রিকার প্রধান শিরোনাম।

প্রতিযোগিতার প্রতিটি ধাপে ধাপে এগোতে থাকে জেনি আর সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীর মধ্যে। জেনি যে মাঝে মধ্যেই আত্মহত্যা করতে চায় তার অন্যতম কারণ তার সন্তানবিয়োগ ঘটনা। জেলখানায় জেনিকে ষোল ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হতো। সন্তান ভূমিষ্ঠের শেষ

দিকে ডাক্তারকে বলা হলো, আমি আর পারছি না। ডাক্তাররা বললো, ভয় নেই সিজারি করে সন্তান আনা হবে। অথচ প্রয়োজনের সময় তা করা হলো না। নার্সরা বললো ভূমিষ্ঠ সন্তান মৃত। সন্তানের নাম রেখেছিলাম অস্কার। তারা আমার অস্কারকে কেড়ে নিল।

বিনিময়ে ফেরত দিল কান্না। অপরদিকে জেনির সৎ পিতার কাছ থেকে শিক্ষিকা ট্রেউডি জানতে পারে, জেনি আসলে মানুষ হত্যা করেনি। জেনি যাকে ভালোবাসতো সেই ছেলেটি তার বাবাকে হত্যা করেছিল। সেই ছেলের দায় সে তার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

উপরন্তু আমি তার সৎ বাবা এবং তাকে পিয়ানো বাজানোর লোভ দেখিয়ে আমি তার সর্বস্বান্ত করি। জেনি তার মাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে এ সত্য প্রকাশ করেনি বটে কিন্তু চিরদিনের মতো পিয়ানো বাজানো ছেড়ে দিয়েছে।

সবার অবিচার অত্যাচারে অতিষ্ট জেনি কাউকে দোষারোপ না করে কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেই নিজেকে কারারুদ্ধ করেছে। শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ কর্মদোষে দোষী কিন্তু হ্যামলেট তা না। তবু হ্যামলেট যেমন অন্যের দোষে নিজে শাস্তি পেল আমার মেয়ে জেনিও তেমনি।

যেমনভাবে চলচ্চিত্রের শুরুতে জেনি আঘাত করেছিল গার্ড মুটজিকে তেমনি মুটজি সুস্থ হয়ে চাকরিতে ফিরে বন্দুক তাক করে জেনিকে। জেনি ততদিনে অনেকটাই স্বাভাবিক। অন্তরের উচ্চারণ, দুঃখিত। মুটক্তি বিস্মিত। মুটকি হত্যার ব্যাপারে পুনঃবিচার করলেও সঙ্গী কয়েদি গ্যাং কম্পিটিশনের আগের রাতে ঘুমন্ত জেনির হাতে আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে করে জেনি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে না পারে।

ধ্বস্তাধ্বস্তির একপর্যায়ে গ্যাংলিডার জেনির হাতে মারাত্মক আহত হয়। প্রতিযোগিতার দুদিন আগেও যে জেনি মানুষ খুন করতে পারে সে না মঞ্চে কি করে— সেই আশঙ্কায় জেলার বোর্ড জেনির অংশগ্রহণ বাতিল করে। যে মুটজি জেনিকে মারতে বন্দুক তাক করেছিল তারই সহযোগিতায় শিক্ষিকা ট্রেউডিকে লুকিয়ো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য নিয়ে আসে।

পারফর্ম করার জন্য জেনি যখন মঞ্চে তখন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে জার্মান পুলিশ। হেড জেলারকে শিক্ষিকা বলে, আমিই তাকে লুকিয়ে এনেছি। যা শাস্তি দেয়ার আমাকে দেবেন। একদিন আমি প্রিন্ট মিডিয়ার সামনে আপনার সম্মানের স্বার্থে আপনার চাওয়া চার মিনিটের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েছিলাম।

আর আজ আমি আপনার কাছে আমার জেনির জীবনের স্বার্থে চার মিনিট সময় চাই তাকে পিয়ানো বাজানো শেষ করতে দিন। হেড জেলার রাজি হওয়ার আগেই জেনির তোলা সুরের ঝংকারে হলভর্তি শ্রোতা-দর্শক ঘোরে বিভোর।

 

ফোর মিনিটস 

 

জেনি যা বাজাচ্ছে যেভাবে বাজাচ্ছে এও কি সম্ভব? চার মিনিট শেষেই জেনির পিয়ানো বাজানো শেষ হলে ত্রিশ সেকেন্ড পর্যন্ত দর্শক হতভম্ব। কি করবে বুঝতে না পেরে হতভম্ব, বিহ্বল। তারপরই তিন গ্যালারি ভর্তি দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালি।

দর্শক যখন দাঁড়িয়ে শিল্পী জেনিকে অভিবাদন জানাচ্ছে তখন জার্মান পুলিশ জেনির হাতে পরিয়ে দিচ্ছে হাতকড়া। ফোর মিনিটস চলচ্চিত্র সেখানেই শেষ কিন্তু পরিচালক ক্রিস ক্রসের যেন উদাত্ত আহ্বানের শুরু, ভালো যে হতে চায় তাকে ভালো হতে দিন।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment