প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়ার জন্ম আসামের গৌরীপুরে। রাজপরিবারের সন্তান প্রমথেশ ছেলেবেলা থেকেই প্রথাগত শিক্ষার সাথে খেলাধুলায়, শিকারে এবং সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। আসাম থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন ১৯২৪ সালে।
প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া । বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা
বেশ কিছুদিন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ্য দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৮-৩৪ সালে আসাম বিধানসভার সদস্য ছিলেন। ১৯২৬ সালে ইউরোপ যান চলচ্চিত্রবিদ্যা শেখার জন্য। ফ্রান্সের ফক্স স্টুডিওতে শিক্ষানবিশ হিসাবেও যুক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মসের সাথে যুক্ত হন, এবং ঐ প্রতিষ্ঠানে তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেন।
ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান প্রযোজিত ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত টাকায় কি না হয় (১৯৩১) নির্বাক ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয়। ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট। এই প্রতিষ্ঠান নির্বাক মুখে তিনটি ছবি প্রযোজনা করে, তার মধ্যে অপরাধী (১৯৩১) এবং নিশির ডাক (১৯৩২) দুটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন দেবকী বসু এবং একদা (১৯৩২) ছবিটি পরিচালনা করেন সুশীল মজুমদার।
অপরাধী কৃত্রিম আলোর সাহায্যে তোলা প্রথম ছবি এবং এই ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া অভিনয় করেন নায়ক নিরঞ্জনের ভূমিকায়। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বড়ুয়া পিকচার্স’। এই প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ১৯৮৩ (১৯৩২) নামে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য এবং শিবরাত্রি (১৯৩২) নামে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করে। বেঙ্গল ১৯৮৩ ছবি পরিচালনার পাশাপাশি প্রমথেশ এই ছবিতে কুমার বাহাদুরের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন।
১৯৩৩ সালে প্রমথেশ নিউ থিয়েটার্সের সাথে যুক্ত হন। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে রূপলেখা (১৯৩৪), দেবদাস (১৯৩৫), মুক্তি (১৯৩৭), অধিকার (১৯৩৮) প্রভৃতি বাংলা ও হিন্দী দ্বিভাষিক ছবি সহ কয়েকটি বাংলা ও হিন্দী ছবিও পরিচালনা করেন। নিউ থিয়েটার্সে তাঁর শেষ ছবি জিন্দেগী ১৯৪০ সালে মুক্তি পায়। এই পর্বে তাঁর পরিচালনায় তৈরি দেবদাস, মুক্তি, রজত জয়ন্তী (১৯৩৯) সহ অন্য ছবিগুলি দর্শক সমাদর লাভ করে।
তৎকালীন পত্রপত্রিকায় ছবিগুলির সদর্থক সমালোচনা প্রকাশিত হয়। দেবদাস মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই প্রমথেশ বাংলা ছবির জগতে স্টার হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। মুক্তি ছবিটি তাকে সর্বভারতীয় পরিচিতির পাশাপাশি সার্থক শিল্পী হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৩৯ সালের শেষে প্রমথেশ নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে এম. পি. স্টুডিওর সাথে যুক্ত হন এবং তিনটি ছবি পরিচালনা করেন। এর মধ্যে তিনি কৃষাণ মুভিটোনের হয়ে শাপমুক্তি (১৯৪০) ছবিটিও পরিচালনা করেন। এম. পি.র প্রযোজনায় তৈরি প্রমথেশ পরিচালিত উত্তরায়ণ (১৯৪১) এবং শেষ উত্তর (১৯৪২) দর্শক সমাদর লাভে সমর্থ হয়।
ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর প্রযোজনায় মায়াকানন (১৯৫৩) ছবিটি পরিচালনার কাজ তিনি শেষ করতে পারেন নি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সহকারী বিস্তৃতি চক্রবর্তী ছবির অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন।
এম. পি. এবং ইন্দ্রপুরী পর্বে তাঁর পরিচালিত ছবিগুলির সঙ্গে তিনি প্রযোজক হিসাবেও যুক্ত ছিলেন। শাপমুক্তি ছবি তৈরির সময় থেকেই তিনি নিজের চিত্রনাট্য অবলম্বনে ছবি পরিচালনা করতেন এবং এই ছবিগুলির চিত্রগ্রহণও তিনি নিজেই করেছেন। ১৯৪৭ সালে প্রমথেশ শুধুমাত্র প্রযোজক হিসাবে জাগরণ ছবির সাথে যুক্ত ছিলেন। ছবিটি পরিচালনা করেন বিভুতি চক্রবর্তী।
২১ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে ২২টি ছবি (বাংলা, হিন্দী) পরিচালনা, ২১টি ছবিতে অভিনয়, ৫টি ছবির চিত্রগ্রহণ, ৯টি ছবি প্রযোজনা করেছেন। বাংলা ভাষায় সতেরোটি ছবিতে অভিনয়ের সাথে হিন্দী ভাষায় নির্মিত মুক্তি ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র, দেবদাসে পার্বতীর সৎ ছেলে মহেন্দ্র, মঞ্জিল এবং অধিকার ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
বাংলা ছবিতে নিরঞ্জন (অপরাধী), কুমার বাহাদুর (বেঙ্গল ১৯৮৩), দেবদাস (দেবদাস), মহিম (গৃহদাহ), প্রশান্ত (মুক্তি), নিখিলেশ (অধিকার), রজত (রজত জয়ন্তী), রমেশ শাপমুক্তি), সলিল (উত্তরায়ণ), মনোজ (শেষ উত্তর) ইত্যাদি অভিনীত চরিত্রগুলি দর্শক সমাদর লাভের পাশাপাশি, চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রশংসাও অর্জন করে। বিশেষ করে দেবদাস ও মুক্তি ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
চলচ্চিত্রপঞ্জি —
- ১৯৩১ টাকায় কি না হয়, অপরাধী
- ১৯৩২ ভাগ্যলক্ষ্মী, একদা, নিশির ডাক, বেঙ্গল ১৯৮৩,
- ১৯৩৪ রূপলেখা, মহব্বত কি কসৌটি (হিন্দী):
- ১৯৩৫ দেবদাস (দ্বিভাষিক), অবশেষে
- ১৯৩৬ গৃহদাহ, মঞ্জিল (হিন্দী), মায়া (হিন্দী), শিবরাত্রি:
- ১৯৩৭ মুক্তি (দ্বি):
- ১৯৩৮ অধিকার (দ্বি)
- ১৯৩৯: রজত জয়ন্তী
- ১৯৪০ জিন্দেগী (হিন্দী), শাপমুক্তি
- ১৯৪১ মায়ের প্রাণ, উত্তরায়ণ
- ১৯৪২ শেষ উত্তর:
- ১৯৪৪ চাঁদের কলঙ্ক,
- ১৯৪৭ জাগরণ
- ১৯৫৩ মায়া কানন।
আরও দেখুনঃ