আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ দ্য ফ্যামিলি জুয়েলস ।
দ্য ফ্যামিলি জুয়েলস
দ্য ফ্যামিলি জুয়েলস
চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ :
রোগের সাথে রোগীর মনস্তাত্ত্বিক লড়াই।
দেশ : জার্মানি
পরিচালক : রবার্ট সেচুয়েনটেক
লেখক : রবার্ট সেচুয়েনটেক
রিলিজ ডেট : ১ জানুয়ারি ২০০৩
মূখ্য চরিত্র : ওথান উইলকি
জুলিয়া হিউমার
অ্যান্টনী মনোট
দ্য ফ্যামিলি জুয়েলস
কি গুণাবলী থাকলে বোঝা যাবে প্রকৃতই তিনি গুণী চিকিৎসক এ ব্যাপারে অসংখ্য মতবাদ থাকলেও যেটি সবার কাছে গণ্য সেটি হলো সর্বকালের সেরা ডিপ্লোম্যাট চানক্যের উক্তি। তাঁর মতে যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, সবার কাছেই প্রিয়দর্শন, সংস্বভাব ও সদাশয় তিনিই রাজবৈদ্য হওয়ার যোগ্য।
একজন ভালো চিকিৎসককে সময়মতো পাওয়া যে কত সৌভাগ্যের ব্যাপার সেটা ভুক্তভোগী রোগী মাত্রই জানেন। তেমনই একজন চিকিৎসক অর্থোপেডিক ও ট্রমাটিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ সার্জন প্রফেসর ডা. মোঃ মোশাররফ হোসেন।
চিকিৎসক হিসেবে বিষয়ের উপর গভীর ধারণা থাকলে, রোগ উৎপত্তির কারণের মূলে মনোচক্ষু দিয়ে প্রবেশ করতে জানলে, অযাচিত টেস্টের খরচার হাত থেকে যে রোগীকে রেহাই দেয়া যায় এবং ন্যূনতম ঔষধ প্রেসক্রাইবের মধ্য দিয়ে যে রোগ সমূলে নির্মূল করা যায় সেটা তার তত্ত্বাবধানে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষমাত্রই জানেন।
তার নিজস্ব বিশ্বাস একজন জ্ঞানীর জ্ঞান আহরণের জন্য যেমন শেষ কথা বই, বই এবং বই, তেমনি একজন রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে শেষ কথা নার্সিং, নার্সিং এবং নার্সিং। নার্সিং শেষ কথা হলেও নার্সিং নেয়ার সুযোগ তো সব সময় রোগীর পক্ষে সম্ভব নয়। ধরা যাক, গ্যাংরিনে আক্রান্ত এক রোগীর পা কেটে বাদ দিলে। গ্যাংরিন সমস্ত দেহে ছড়াবে না এটার খরচ পঞ্চাশ হাজার।
যদি একমাসে টানা নার্সিং এর মধ্য দিয়ে পা অক্ষত রেখে সুস্থ করে তোলা হয় তবে তার খরচ চার লাখ টাকা। কি করবে রোগী। পা বাদ দিয়ে মোটামুটিভাবে নিজে এবং পরিবারকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন কাটাবে নাকি পা রক্ষা করতে যেয়ে সামান্য জমি জায়গা ভিটে মাটি সব বেচে পরিবার-পরিজন নিয়ে পথে উঠবে শূন্য থালা হাতে নিয়ে?
রোগী কি করবে সেটা জানা না হলেও প্রফেসর ডা. মোঃ মোশাররফ হোসেনের সাহেবের কথাই বার বার মনে হচ্ছিল জার্মান কালচারাল সেন্টারে বসে জার্মান পরিচালক রবার্ট সেচুয়েনটেক পরিচালিত চলচ্চিত্র “দ্য ফ্যামিলি জুয়েলস’ চলচ্চিত্রটি দেখতে দেখতে যেখানে চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র মার্টিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে, সঞ্চিত সামান্য অর্থ দিয়ে আমেরিকান বস্টন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করবে নাকি হার্নিয়া রোগের চিকিৎসার জন ডাক্তারের কাছে যাবে।
ডাক্তারের কাছে যাবে কি যাবে না সে সিদ্ধান্ত সদ্য আমেরিকান বস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ফিরে আসা জার্মান নাগরিক মার্টিন নিতে না পারলেও রোগের ব্যথায় কাতরানো দশা কিছুতেই লুকাতে পারে না “শৈশবের বন্ধু রোমানের (আলেকজান্ডার বেয়া) কাছ থেকে। বন্ধু রোমান সব জেনে ফোন করে পরিচিত ডাক্তার বফিনজারকে।
প্রাথমিক টেস্ট সম্পন্ন হলে ডাক্তার নিশ্চিত করে মার্টিন (ওয়াটন উইকি মহোরিং) কে হসপিটালাইজড করতে। হাসপাতালে নানা টেস্ট সম্পন্ন হলে মার্টিন অপেক্ষা করতে থাকে মা আসার জন্য। কেবিনের এ ঘর সে ঘর ঘুরতে ঘুরতে মার্টিন দেখতে পায় সুমানি (জুলিয়া হিউমার) নামের একটি মেয়েকে, যে কিনা ডাক্তারের অবর্তমানে ডাক্তারের আলমারি থেকে লুকিয়ে ওষুধ নিচ্ছে।
হঠাৎ করে ঘরে ডাক্তার এলে প্রয়োজনে যে সুসানির সাথে কথা বলছে এমনটা ভাব করে। সুসানিকে সে যাত্রা রক্ষা করে মার্টিন। লিফটে ওঠার সময় সুসানি কৃতজ্ঞতার সাথে বলে, মার্টিন আমি তোমাকে মনে রাখবো কারণ প্রথম বেলায় তুমি আমাকে বাঁচালে
বাঁচার স্বার্থেই যে অপারেশনটা জরুরি সে কথা ডাক্তার রফিজার বলে। মার্টিন এবং মার্টিনের মাকে। মার্টিন অপারেশনে নির্ভর না করলেও মার্টিনের মা নাছোড়বান্দা। মায়ের একটাই কথা, বস্টনে যেয়ে তোমাকে পিএইচডি করতে হবে।
তোমার স্বর্ণালী ভবিষ্যতের স্বার্থে রোগকে নির্মূল করা একান্তই দরকার। ঋণের সুদ যেমন তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। একসময় বড় আকার ধারণ করে রোগও তেমন। রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল না করলে তা বাড়তেই থাকে। সুতরাং এখনই অপারেশন করে এ রোগ থামাতে হবে।
থামবে না বাড়বে সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি হয় মার্টিন। অনভিজ্ঞ নার্সের এফোঁড় ওফোঁড় ইনজেকশন পুশের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে চেতনা লোপ পেতে থাকে মার্টিনের। পরিচালক রবার্ট সেচুয়েনটেক অদ্ভুদ কিছু শট দেখিয়েছেন দর্শকদের।
সামনের লক্ষ্যবস্তুগুলো খরা রোদে ঝলসানোর জায়গা থেকে আস্তে আস্তে কুয়াশার ঘেরাটোপে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আর সেই গাঢ় কুয়াশার মধ্য থেকে তীক্ষ্ণ টর্চের আলোর ঝলকানি নিয়ে এগিয়ে আসছে অপারেশন টেবিলের উপরের আলোকরশ্মি। অর্থাৎ অপারেশন টেবিলে শোয়া মার্টিনের অপারেশন শুরু।
অপারেশন হওয়ার আগে চেতনা নাশ করা হয়েছিল যে মার্টিনের সেই মার্টিন জ্ঞান ফিরে দেখে সে কেবিনের বেডে। সম্মুখে নার্স, ডাক্তার। স্বাভাবিক হয়ে সে ডাক্তারদের কথার সূত্র ধরে বুঝতে পারে জননাঙ্গের টেস্টিকুলার অপারেশন করে বাদ দেয়া হয়েছে।
শরীরের যে কোনো অঙ্গহানি যে কত বেদনার তা মার্টিনের সাথে সাথে হলভর্তি দর্শকেরও সেটা মনে হয়। কিন্তু সেই বেদনার মধ্যে আরো খারাপ লাগে যখন মার্টিন দেখতে পায় তার কেবিনের পাশের বৃদ্ধ রোগীর মুমূর্ষু দশা। এই আছি এই নেই। মার্টিন নিদারুণভাবে চায় অন্য সিঙ্গেল কেবিন। কেবিন জোগাড় না হলে বন্ধু রোমানকে ডেকে হাসপাতাল থেকে পালায় মার্টিন। পুনরায় ফিরেও আসে।
পুনরায় ফিরে এসে যে কেবিন রুম পায় সেখানে দুই টেস্টিকুলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী হেরি এবং নিকোল। উভয়ের মাথায় কোনো চুল নেই। দুজনে টেলিভিশনে ফিল্ম দেখে। নতুন জায়গায় অ্যাডজাস্ট করে নিতে চাইলেও হেরি আর নিকোলের অসহযোগিতায় রাতে বই নিয়ে বাইরে পড়তে বসে। সেখানেই আসে সুসানি। সুসানি নিজেও টেস্টিকুলার রোগে আক্রান্ত । সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে সুসানি এবং মার্টিনের মধ্যে ভালোবাসা দানা বাঁধে।
সুসানি এবং মার্টিনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় হেরি। বিরোধপূর্ণ পরিবেশ এক সময় শান্ত হয় এবং হেরি তৈরি হয় বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যাওয়ার মুহূর্তে গলার টনসিলের জায়গা টিপে ডাক্তার যাওয়ার অনুমতি পারমিট করে না। হেরির উচ্ছ্বাসের চোখ ভরে ওঠে জলে। দর্শকদেরও খারাপ লাগে।
খারাপ লাগে মার্টিনের জন্য। মার্টিনের সমস্ত শরীরে টেস্টিকুলার ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে। অপারেশনের ঘা শুকাচ্ছে না। উপরন্তু তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সমস্ত দেহে। ডাক্তারের সিদ্ধান্ত কেমো থেরাপি প্রয়োগ। দগদগে ঘাকে শুকিয়ে রাখার চেষ্টা।
কেমো থেরাপি প্রয়োগের দৃশ্যে লাইটের কাজ দেখার মতো। কারেন্টের লাইনের মিটার বাক্স ব্লাস্ট হলে যেমন তীর্যক আলোকরশি ছিটকায় অনেকটা সেরকম আলোকরশ্মিতে ঝলসানো হয় মার্টিনকে। কেমো থেরাপি প্রয়োগে সব থেকে মর্মান্তিক দৃশ্য তখন যখন বেসিনের সামনে মার্টিন নিজের মাথার চুল ধরে টানতে থাকলে থোকা থোকা চুল হাতের মুঠোয় উঠে আসে।
এক সময় মার্টিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আসায় লাগেজ গোছাতে থাকলে সুসানির সাথে কথা হয়। মার্টিন সুস্থতা নিয়ে বাড়ি ফেরায় সুসানি আনন্দিত কিন্তু আপনজন মার্টিন চলে যাচ্ছে দেখে সুসানি ব্যথিত। শেষবারের মতো মার্টিনকে ভালোবাসার আলিঙ্গনে পেতে যেয়ে সুসানি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সুসানির কথামতো ড্রয়ার থেকে সবুজ ঔষধ দিয়ে সে যাত্রা সুস্থ করে তোলে।
একটু পরে মার্টিন যখন বোঝে ঔষধটি আসলে ড্রাগ এবং এই ড্রাগ নিতে সুসানিকে না করে। উত্তরে সুসানি বলে, মার্টিন তুমি একজন ভিজিটর, এলে এবং চলেও যাচ্ছ। কিন্তু আমি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমার অবসান। ড্রাগ নিই আর ঔষধ নিই, বাঁচার কয়দিন অন্তত আনন্দ নিয়ে বাঁচি ।
আনন্দের পরিবর্তে নিরানন্দ নিয়ে মার্টিন বাড়িতে ফেরে। তার মন হাসপাতালে সুসানির কাছে। রাতে ব্যাকুল হয়ে মার্টিন আবার হাসপাতালে দৌঁড় লাগায়। হায় হায় অসুস্থ সুসানি ভালো আছে তো! প্রতি রাতে যে সুসানি তাকে একবার না দেখে থাকতে পারেনি সে এখন কি করছে। মার্টিন সুসানির বেড়ে যেয়ে দেখে বেড শূন্য। ওয়ার্ড বয় বলছে সুসানি ইনটেনসিভ কেয়ারে।
বিছানায় মশারি টাঙ্গালে যেমন হয় তেমনটা প্লাস্টিকের মশারির মধ্যে শোয়া সুসানি। পরিচালক ভালোবাসার একটা চমৎকার দৃশ্য উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। সুসানি স্টেথোস্কোপের চেপে ধরা গোল অংশটা এগিয়ে দেয় প্লাস্টিকের মশারির তল থেকে মার্টিনের দিকে।
মার্টিন তা চেপে ধরে নিজের বুকে। হেডফোনের মতো অংশ নিজের কানে দেয় সুসানি। ব্যাকুল হৃদয়ের ধকধক তরঙ্গধ্বনি শুনে হাসি ফুটে ওঠে সুসানির সমস্ত মুখে। প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের অস্থির ব্যাকুলতা দেখে কোন প্রেমিক না খুশি হয়।
সারা রাত পার হয়ে ভোর হয়। সুসানি তৃপ্তি নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। যে নিকেল কথা বলতে পারতো না অসুস্থতার কারণে সেও মুসানিকে দেখে বলে, লুকিং লাইক এ এঞ্জেল (দেখতে দেবীর মতো)। মার্টিন শেষ চুম্বন দেয় সুসানিকে। হাসপাতালের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি বিরাগ হয়ে মার্টিন ডাক্তার বফিনজারকে বলে, হোপ উই উইল নট মিট এগেইন (আশা করি আমাদের আর দেখা হবে না)।
হাসপাতালের বন্ধ অঙ্গন থেকে বেরিয়ে মুক্ত ময়দানে দাঁড়িয়ে মার্টিন বুক ভরে বাতাস নেয়। আহা! বেঁচে থাকার কি আনন্দ। মুক্ত আকাশ, নির্মল বাতাস আর সেই বাতাসে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলে মার্টিন আর সেখানেই শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘দ্য ফ্যামিলি জুয়েলস’।
আরও দেখুনঃ