আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ তেজোদীপ্ত পদচারণায় : চলচ্চিত্রাঙ্গন জার্মানি ।
তেজোদীপ্ত পদচারণায় : চলচ্চিত্রাঙ্গন জার্মানি

তেজোদীপ্ত পদচারণায় : চলচ্চিত্রাঙ্গন জার্মানি
দাঁতের ফাঁকে ভাতের কণা মাছের কাঁটা মাংসের আঁশ আটকে গেলে মুহূর্তে জিহ্বা তা সরিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে দাঁত সুযোগ পেলে জিহ্বাকে কামড় দিতে ভুলেও ভুল করে না। এক মুখের মধ্যে যদি এমন পক্ষের শক্তি বিপক্ষের শক্তি সমানভাবে কাজ করে চলে তবে মুখের অধিকারী মানুষ যদি একটু সময় সুযোগ অবসর পেয়ে তর্ক-পাল্টা তর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তির কথায় সমুদ্রে ঢেউ তোলে কিংবা ঝড়ও তোলে তবে মানুষকে দোষ দেয়া চলে না।
তো সেই মানুষের মনে হতেই পারে যেহেতু হা-ডু-ডু বৈচিত্র্যপূর্ণ খেলা সেহেতু খেলার মাঠে বিপরীত দলের খেলোয়াড়ের পা কিভাবে টেনে ধরে রাখা যায় সেটার উপর নজর দেয়া দরকার। আবার অপর কেউ বলতে পারে পা টানাটানি না করে বরং পা দিয়ে বল জালে ঠেল কিভাবে গোলের সংখ্যা বাড়িয়ে দলকে জেতানো যায় বরং সেটাই এখন ভাবনার সময়।
ভাবনায় দর্শক হৃদয় হা-ডু- ডুমুখী হবে না ফুটবলমুখী হবে, আবাহনীমুখী হবে না মোহামেডানমুখী হবে সেটা সম্পূর্ণই দর্শকদের একান্ত ব্যাপার। সেখানে কোনো সাজেশন চলে না। সাজেশন একটাই চলতে পারে আর সেটা হলো পছন্দের ব্যাপারে নো সাজেশন। যেমন আর্জেন্টিনার দিয়াগো ম্যারাডোনাকে আমাদের কম-বেশি সবার বেশ ভালো লাগে।
দর্শকদের কেন ভালো লাগে এটিও একান্ত ভালো লাগার। তেমনি ভালো লেগেছিল গোলরক্ষক অলিভার কানকে। ২০০২ সালে বিশ্বকাপে সবার আকর্ষণে ছিল গোলরক্ষক অলিভার কান আর ২০০২ সালই ছিল অলিভার কানের শেষ বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপ ২০০২-এর ফাইনাল রাউন্ডে ব্রাজিল যখন কোনোভাবেই অলিভার কানকে পাশ কাটিয়ে বল জালে ঢোকাতে পারছে না তখন ব্রাজিলের রোনালদো মাটি গড়িয়ে একটা বল শট করে। লম্বা চওড়া অলিভার কান নিচু হতে দেরি করায় গোল হয়ে সারা।
এক গোল খেয়ে অলিভার কানের দল যখন মারমুখী তখন রোনালদোর শটে পুনঃ এক গোল। ২০০২ সালে ২-০ গোলে জিতলো ব্রাজিল। হারলো জীবনের শেষ বিশ্বকাপের ফাইনাল গোলরক্ষক অলিভার কান। হারলো অলিভার কানের দল জার্মানি, অলিভার কানের দেশ জার্মানি।
জার্মানির গত একশ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটনাটাও অনেকটা ২০০২ সালের ফাইনাল ম্যাচের মতো। জার্মানির মানচিত্র একটি বৃক্ষ হলে বৃক্ষের ঠিক যেখানটায় শিকড় সেখানকার দেশ হলো অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রান্সিস ফার্ডিনেন্ডকে হত্যা করা হলে অস্ট্রিয়ার সমব্যথায় সমব্যাথী হয়ে সহযোগিতার প্রশ্নে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো জার্মানি।
রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেনের যুগ্ম আক্রমণে পরাজিত হলো জার্মানি ও তার অক্ষ শক্তি। জার্মানির গলায় পরানো হলো কাঁটার মালার মতো ভার্সাই চুক্তি। তেজোদীপ্ত জার্মানির জন্য লজ্জা এবং লজ্জা। প্রথম লজ্জা জার্মানিকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হলো।
দ্বিতীয় লজ্জা হলো জার্মানরা হয়ে গেল যুদ্ধাপরাধী আর সে কারণে তারা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তৃতীয় লজ্জা এই চুক্তি চাপিয়ে দিল বিজয়ী রাষ্ট্রগুলো। যাদের মান আছে তারা বোঝে অপমানের যন্ত্রণা কত নির্মম। বলতে গেলে গোল খেলে জার্মানরা যেমন রাফ খেলা শুরু করে অনেকটা সে রকম ভার্সাই চুক্তির মতো নির্লজ্জ চুক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়েই হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানদের পুনঃদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। ফলাফলও ২002 বিশ্বকাপের মতো পরাজয় পরাজয় জার্মানির, পরাজয় হিটলারের।
হিটলারের পরাজয় ঘটলেও হিটলার যে মানুষের মনে কোন জায়গায় সেটা বোঝা যায় চলচ্চিত্র দ্য প্রোডিউসার্স দেখলে। আমাদের থেকে বয়সে তুলনামূলক এগিয়ে এরকম বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই ‘দ্য প্রোডিউসার্স’ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন।
সেখানে দেখ যায় দুই মার্কিন কোটিপতি আয়কর ফাঁকি দেয়ার জন্য এমন একটি ব্যবসা খুঁজছে যে ব্যবসা করলে নিশ্চিত লোকসান হবে এবং তারা দেউলিয়া হয়ে গেছে— এই যুক্তি দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে আয়ের ওপর কর দেয়ার হাত থেকে মুক্তি পাবে।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করে তারা নিশ্চিত হলো যেহেতু অ্যাডলফ হিটলার একজন ঘৃণিত ব্যক্তি, গণহত্যাকারী ফলে হিটলারকে নিয়ে যদি একটা মঞ্চ নাটক করা যায় তবে লোকে ঘৃণাভরে সে নাটক বর্জন করবে এবং যথারীতি নিজেদের ব্যবসায় দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দুই কোটিপতি যেদিন নিউইয়র্ক শহরে হিটলারকে নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করলো সেদিন বক্স অফিস খাঁ খাঁ করা তো দূরের কথা, পুরো নিউইয়র্ক যেন ভেঙে পড়লো নাটকটি দেখতে। নাকটটি যেমন সুপার ডুপার হিট হলো তেমনি দেউলিয়া ঘোষণার পরিবর্তে কোটিপতি দুজনের আয়কর পরিশোধের অঙ্কটা গেল বেড়ে।
বেড়েছে আবেগ তাই বলে যে জার্মানরা বিচারবোধ স্বকীয়তা বিসর্জন দেবে সেটা অন্তত না ভাবার পক্ষে চেক রিপাবলিকের অস্কার বিজয়ী পরিচালক জিরি মেনজেল। জিরি মেনজেন তার ভুবনবিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘আই সার্ভ দ্য কিং অব ইংল্যান্ড’-এ যুক্ত করেছেন চমৎকার দৃশ্য।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র চেক যুবক ডিটেই দস্যুদের হাত থেকে লিজা নামের এক তেজোস্বিনী রূপসী জার্মান ললনাকে রক্ষা করে। উপকারের প্রতিদান দিতে জানে জার্মান জাতি। ডিটেইকে বিভিন্ন সময় উপকারের প্রতিদানের কোন এক পর্বে লিজার মনে হয় ডিটেই লিজাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
অযথা সময় নষ্ট করার বিপক্ষে লিজা। ভালোলাগার পরিণতি ভালোবাসা, ভালোবাসার চূড়ান্ত গন্তব্য বিবাহ। ফলে লিজা ডিটেইকে বলে, ডিটেই তুমি ভালো ছেলে, দায়িত্ববোধসম্পন্ন সুন্দর মনের মানুষ। তোমাকে আমার জীবনসঙ্গী করে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তিই নেই।
কিন্তু ডিটেই, আমরা জার্মান। আমার শরীরে ব্লু ব্লাড তথা নীল রক্ত। ব্লু ব্লাড নেতৃত্বের প্রতীক। ক্ষমতার প্রতীক । এখন যদি আমি তোমাকে বিয়ে করি তবে ক্রস কালচারের কারণে জার্মানি নবপ্রজন্ম নেতৃত্ব শূন্য কিংবা বিপর্যস্ত হতে পারে। ফলে হিসাব মতে সেটা সম্ভব নয়।
কিন্তু ডিটেই তোমার উচ্চারণে মাঝে মাঝেই জার্মান উচ্চারণ আসে। আমার বিশ্বাস তোমার পিতৃপুরুষের কেউ না কেউ জার্মান । আর সেটা সত্য হলে ডিটেই, বিশ্বাস করো তোমাকে জীবনসঙ্গী করে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে আমার কোনো আপত্তি নেই। ডিটেই-এর পিতৃপুরুষদের কবর খুঁজতে খুঁজতে ডিটেই-এর দাদা জার্মান নিশ্চিত হয়েই চেক যুবক ডিটেইকে জীবনসঙ্গী করে জার্মান ললনা লিজা।
নিজেদের স্বতন্ত্র বোধ, নিজেদের নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদেরকে উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নেয়া, দুদুটি বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েও বর্তমান বিশ্বে এত অল্প সময়ে যেভাবে মূলস্রোতে জার্মানির ফিরে আসা সেসব সত্তা নিয়ে যে জার্মানি সেই জার্মানির চলচ্চিত্রের পরিক্রমায় এই সামগ্রিক বিষয় দুধে-জলে মিশে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক এবং সহজ ব্যাপার। হয়েছেও তাই।
তাই হোক আর যাই হোক এ কথা তো সত্যি পিঁপড়া, ভেড়া চলে দল ধরে কিন্তু বাঘ সিংহ চলে একা একা। বাঘ যেমন একা চলে তেমনি বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়। ফ্রান্সের ফটোগ্রাফজগতে বাঘা পুরুষ ছিলেন আঁতোয়া লুমিয়ের। স্থিরচিত্র তুলতে পারায় তার যেমন খ্যাতি ছিল ঠিক তেমনি তার নির্মিত ফ্যাক্টরি যেখান থেকে ফটোগ্রাফের মালমশলা প্রস্তুত হতো সেই ফ্যাক্টরি ছিল তখনকার সময় বিশ্বের ২য় নম্বর প্রতিষ্ঠান।
সেই আঁতোয়া লুমিয়েরের দুই পুত্র তাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলো বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়। বড় ভাই অগাস্ট লুমিয়ের এবং ছোট ভাই লুই লুমিয়ের, দুই দাদা ভাই মিলে মিশে জগৎসভায় যে ‘সিনেমাটেগ্রাফি’ যন্ত্র নির্মাণ করলেন সে কারণে তারা হয়ে গেলেন চলচ্চিত্র মাধ্যমের স্রষ্টা।
২০০৮ সালে ‘নো কান্ট্রি ফর দ্য ওল্ডম্যান’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে যেমন দুই দাদা ভাই জোয়েন কোয়েন এবং এথান কোয়েল অস্কার পুরস্কার জিতে নিল ঠিক তেমনিভাবে বড় ভাই অগাস্ট লুমিয়ের এবং ছোট ভাই লুই লুমিয়ের দাদা ভাই মিলেমিশে জগৎসভায় যে ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ যন্ত্র নির্মাণ করলেন সে কারণে তারা হয়ে গেলেন চলচ্চিত্র মাধ্যমের স্রষ্টা।
লুমিয়ের ব্রাদার্স যেমন মৌলিক সৃজন করলেন ঠিক তেমনি একান্ত মৌলিক না হলেও এনসুজ, লুমিয়ের, টমাস আলভা এডিসনদের করে ফেলা কাজগুলোকে সর্বশেষ অধ্যয়ন করে জার্মান চলচ্চিত্রের একজন অন্যতম অগ্রদূত ওস্কার মিস্টার নিজেই একটা প্রোজেকশন সিস্টেম তৈরি করেন। ওস্কার মিস্টার বিশ্বাস করেছিলেন, ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে ধরে রাখার অন্যতম উপায় চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং এই নির্মিত চলচ্চিত্র শুধু যে বর্তমান প্রজন্মের উপকারে আসবে তা নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও কাজে আসবে।
কাজে আসবে না অকাজে লাগবে সেটা জার্মানবাসীর ভাবনায় দোদুল্যমান হলেও জার্মান প্রশাসন চলচ্চিত্র মাধ্যমের গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে নিজেরা চুম্বক অন্তত চলচ্চিত্র যেখানে লোহা। বাংলাদেশের প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রীর যেমন অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ তেমনি জার্মান প্রশাসনে তৎকালীন প্রধান অবস্থানে কাইজার। কাইজারের অন্যতম আগ্রহ ছিল গতিময় চলচ্চিত্র।
কাইজার শুধু তার আগ্রহকেই মূল্য দিতেন না, চাইতেন আগ্রহের বাস্তবায়ন। ফলে কাইজারের তত্ত্বাবধানে একটা স্টুডিও নির্মাণ করা হয় যেখানে নির্মাতারা চলচ্চিত্র শুট করে রাতারাতি ডেভলপ করে পরের দিনই তা প্রদর্শন করতে পারতো।
জহুরী যেমন জহুর দেখলে চিনতে ভুল করে না ঠিক তেমনি শিক্ষা, বিনোদন, রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচার ও প্ররোচনার হাতিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্র মাধ্যমের গভীরতা এবং বিস্তৃতি বুঝতে জার্মানি হেড অব স্টেট ভুলেও ভুল করেনি।
ভুল করেনি বলে যে একটা মানুষ আর কোনো দিন ভুল করবে না কথাটা যেমন অবান্তর তেমনি অবান্তর মুখ থাকলেই মুখে সব বলা যায়। মুখে যে সব কথা সব সময় বলা যায় না, অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হতে হয় সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে ১৯১৩ সালে জার্মান পরিচালক নির্মাণ করে ফেললেন জার্মান চলচ্চিত্র ‘দ্য আন্দ্রে’।
চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় ফ্রিজ কর্টনার একদিকে খ্যাতিমান অপরদিকে প্রশাসনিকভাবে প্রবল প্রতাপ। ফ্রিজ কর্টনারের সুনামের মুখের আড়ালে যে একটা মুখোশে ঢাকা বিকৃত রূপ আছে সেটা জানে অভিনেত্রী কেথ ভন ন্যাগি।
অভিনেত্রী কেথ ভন ন্যাগি ফ্রিজ কর্টনারের প্রকৃত চরিত্রের কথা জনসম্মুখে তুলে ধরতে মরিয়া হলেও সে নিরূপায়। কারণ অভিনেত্রী কেথ-এর মুখ যেমন বন্ধ থাকে ঠিক তেমনিভাবে সুনামের আচ্ছাদনে ফ্রিজ কর্টনার তার সম্ভাব্য করণীয় অপরাধ করেই চলে। দ্য আন্দ্রে চলচ্চিত্রটি সমগ্র জার্মানিতে জনপ্রিয় হয় এবং জার্মান চলচ্চিত্রের ইতিহাসের শুরুর দিকটায় অন্যতম ভূমিকা রাখে।
ভূমিকা রাখে চলচ্চিত্রবিষয়ক আলোচনা-সমালোচনা সামগ্রিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্র মাধ্যমটিও যে অন্যান্য মাধ্যম অর্থাৎ সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্র, নাটক প্রভৃতি শিল্প মাধ্যমের মতো একটা শিল্প মাধ্যম সেটি বিশ্বে সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় এই ১৯১৩ সালে। জার্মানিতে পল ওগেনার তাঁর সমন্বিত সংকলিত বই ‘আর্কিওলজি অব দ্য সিনেমা’-এর মাধ্যমে এ রকম আলোচনা শুরু করেন।
আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়েই যে একমাত্র চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ বাড়ে না, চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ বাড়াতে শিক্ষিত এবং বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠাটা জরুরি, চলচ্চিত্র মাধ্যমকেও যে হয়ে উঠতে হবে শিক্ষামূলক, বিনোদনমূলক, বিজ্ঞানভিত্তিক সেসব সামগ্রিক ভাব আদর্শকে মাথায় রেখে ১৯১৩ সালেই জার্মানিতে গড়ে ওঠে ‘সিনেমাটোগ্রাফিক স্টাডি’ নামের একাডেমিক সংস্থা।
একাডেমিক সংস্থা থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন অন্ধকার সরাতে আলো জ্বালবে তখন ইউরোপ জড়িয়ে পড়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। প্রতিবেশীর ক্ষতি হলে যেমন পড়শি হাত-পা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকতে পারে না অনেকটা সে রকমভাবে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রিয়ার যুবরাজকে হত্যা করা হলে জার্মানিও সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে থাকতে পারে না।
ফলে জার্মানি জড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। জার্মানি চলচ্চিত্রের ভাবও আদর্শে পরিবর্তন আসে। জার্মানি ১৯১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করে ফেলে ইউনিভার্সাল ফিল্ম এজে (ইউএফএ)। জার্মানির এ প্রতিষ্ঠানের কারণে চলচ্চিত্র শিল্পে লগ্নিকারক প্রযোজক, বড় বড় চলচ্চিত্র কোম্পানির মালিককে একই ছাতার তলে নিয়ে আসে।
ইউএফএ’র অস্তিত্বের উদ্দেশ্য হলো জার্মানিকে এডভারটাইজ করা। প্রচারেই প্রসার কথা আজ আমাদের কাছে শ্লোগানের মতো, কিন্তু এই স্লোগান অনেক আগেই আত্মস্থ করে ফেলেছে জার্মানি। রাজনৈতিক মতবাদ-দর্শন প্রচারের পাশাপাশি জার্মানির ইতিহাস- সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রভৃতির উপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করা এবং প্রচার করা তখন নিয়মিত ঘটনা।
প্রচারের কারণ প্রসার হওয়াটা নিয়মিত ঘটনা হলেও মানুষকে যে তার বিবেচনা, বিচারবোধ পুরোপুরি নির্বাসনে দেয়া চলে না সেই বিষয়কে উপজীব্য করে পরিচালক আর্নেস্ট লুচিক নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘মাদাম দুবেরি’।
১৯১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মাদাম দুবেরি যেমন লাস্যময়ী তেমনি ছলনাময়ী। মাকড়শার পাতা জালের ফাঁদে ধরা পড়ে কীটপতঙ্গ যেমন জীবন হারায় তেমনি রূপসী দুরেরির মোহনীয় রূপের আগুনে নাগর পুরুষরা একে একে সর্বস্ব খোয়ায়।
সাপের বিষ সাপের জন্য ক্ষতি না করলেও সাপুড়ের জন্য মারাত্মক জেনেও সাপ নিয়ে খেলতে সাপুড়ের যখন গর্ব জন্মে, অহংকারের পারদ যখন উতলে ওঠে তখনই না সাপের কামড়ে সাপুড়ের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।
তেমনি নাগররূপী পুরুষদের নিয়ে খেলতে খেলতে গিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে মাদাম দুবেরির জীবনে। মাদাম দুবেরি জীবনে বিপর্যয় নামলেও বিপর্যয়গাথা নির্মাণের কারণে রাতারাতি জার্মানি তথা ইউরোপ ছুঁয়ে সমগ্র বিশ্বের চলচ্চিত্রাঙ্গনে স্বকীয় জায়গা করে নেন পরিচালক আর্নেস্ট লুবিচক।
আর্নেস্ট লুবিচক-এর চলচ্চিত্র মাদাম দুবেরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে অবস্থান করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের কারণে জার্মানি তখন সব দিক দিয়ে বিধ্বস্ত।
একদিকে অখণ্ড জার্মানির খণ্ডদশা, অপরদিকে যুদ্ধাপরাধী হয়ে যাওয়ায় বছর শেষ হতে না হতেই যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা অংকের অর্থ বিজয়ী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া। ফলে জার্মানির রাষ্ট্রীয় অর্থ তহবিল তখন দেউলিয়া।
নগরবাসী মারা যাচ্ছে না খেতে পেয়ে। বেকার যুবকেরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে কর্মখালির সন্ধান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত এসে ভিড় জমাচ্ছে সস্তা মদের দোকানে। যদি নেশার সাগরে ডুব দিয়ে চলমান পৃথিবীর ঘটমান ঘটনা থেকে নিজেকে আড়াল করে কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচে থাকা যায়।
নৈরাশ্য যখন জার্মানিকে ঘিরে ধরেছে, তারুণকে যখন পদদলিত করে চলেছে বার্ধক্যের জ্বরা তখন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার নির্মাণসত্তা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা চলে না। ফলে ঐ সময় জার্মানির কিংবদন্তি পরিচালক ফ্রিজ ল্যাঙ নির্মাণ করলেন।
চলচ্চিত্র ‘ড. মেউেজ দে স্পইলার (ড. মেবিউজ জুয়াড়ি)। চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মেবিউজ একজন জুয়াড়ি। ভাগ্যের উপর নির্ভর করে দুটি বাড়তি পয়সার আশায় তার জুয়ায় দান হাঁকানো। জুয়ার আসর তো আর কোনো দাতব্য চিকিৎসালয় নয় যে চাইলেই রোগের পথ্য পাওয়া যাবে।
উপরও যেখানে জুয়ার আসর বসবে সেখানে বড় টাকার লেনদেন চলবে। বড় দান মারার লোভ দেখানোর জন্য মোহনীয় আলো-আঁধারীর মায়াময় জগৎ নির্মাণ করা হবে। খেলাকে প্রাণচাঞ্চল্য করে তোলার জন্য রূপের পসরা বসানো হবে।
ডুব সাগরে ডুব দেয়ানোর জন্য বোতলের পর বোতল হুইস্কি ঢালা হবে। বোতলের পর বোতল মদ পেটে পুরে অর্থসম্পদ সর্বস্ব খুইয়ে কেউ যদি মাতলামো করে আগের সম্পদ ফিরে পেতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে তবে তাকে ঠেঙ্গিয়ে বারের বাইরে কলার খোসার মতো ছুঁড়ে ফেলতে গাটুগুটু বিশাল দেহের মাস্তান পোষা হবে।
এসবই রয়েছে ড. মেউেজ দে স্পাইলার চলচ্চিত্রে। মেবেউজ সব অর্থ জুয়ার টেবিলে উড়িয়ে যখন সর্বস্বান্ত যখন পুনঃখেলার মতো অর্থ আর একটাও নেই তখন মেবেউজের চূড়ান্ত পতন ঘটে। আমাদের সমাজের হেরোইন, ফেনসিডিল ইয়াবা সেবনকারীরা বাবা- মা, ভাই-বোনদের সঞ্চিত অর্থের সাড়ে সর্বনাশ করে যখন আর কোনোভাবেই কোনো আপনজনের কাছ থেকেই অর্থ যোগাড় করতে সমর্থন হয় না ঠিক তখনই না চাকু রিভলভার নিয়ে পথে নামে যাতে করে নিরীহ পথচারীর সর্বস্ব হরণ করে হলেও নেশা মেটানোর মতো নেশার সামগ্রী কেনা চলে।
ঠিক তেমনিভাবে মেবেউজ নেশা ও জুয়ার অর্থ জোগাড়ের জন্য একটার পর একটা অপরাধ সংঘটিত করে চলে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যে প্রজন্মের পক্ষে কিছুতেই আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানিকে দেখা সম্ভব না তাদের জন্য ‘ড. মেউেজ দে স্পাইলার’ চলচ্চিত্রটি সে দেখাকে খানিকটা হলেও দেখায়। ‘ড. মেবেউজ দে স্পইলার’ চলচ্চিত্রটি কাহিনীর আদলে প্রথম যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির ক্ষয়িষ্ণু সময়ের আস্ত দলিল।
আস্ত দলিল দস্তাবেজ ছাড়াই প্রমাণিত সত্য কথাটি হলো অন্যান্য প্রাণীকুলের মতো মানুষেরও রয়েছে স্বাভাবিক কতগুলো প্রবৃত্তি। যেমন আহার, নিদ্রা, যৌনতাড়না। চলচ্চিত্রে যেখানে মানুষের কথা আসবে সেখানে স্বাভাবিক কারণে মানুষের প্রবৃত্তির কথা আসবে।
জার্মান চলচ্চিত্রেও এসেছে তাই। কিন্তু মুশকিলটা হলো অন্য যে কোনো প্রবৃত্তি অপেক্ষা যৌন প্রবৃত্তি এক অজানা কারণে বিনোদনের উপকরণ হিসেবে বেশি জায়গা দখল করে নিল। জীবন সম্বন্ধিত চলচ্চিত্রগুলো এ সময় যেমন জার্মান চলচ্চিত্রের স্রোতে গা ভাসাল ঠিক তেমনিভাবে চলচ্চিত্রগুলোর বিষয় হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফুটে উঠলো শিক্ষার আড়ালে খোলামেলা যৌনতা। কিন্তু কথায় বলে গাড়ি ক্রসিং
খায় ঠিক তেমনি এসব চলচ্চিত্র জার্মানির সচেতন অধিবাসীদের এবং প্রশাসনের বাধার মুখে পড়ে পিছপা হতে শুরু করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জার্মান সরকার নির্মাতাদের রোধ না করে বরং দর্শকদের রুচির প্রতি বিধিনিষেধ জারি করে।
১৯২০ সালে জাতীয় সেন্সরশিপ আইন চালু করা হয়। ফলে চলচ্চিত্রের সর্বজনীনতা প্রত্যাহার করা হয়। আইনের ফলে যে নিয়মটি সমগ্র জার্মানিতে চালু হয় সেটি হলো বারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা চলচ্চিত্র দেখতে পারবে না।
যখন ছেলেমেয়েদের বয়স বারো থেকে আঠারোর মধ্যে পড়বে তখন তারা শুধু সার্টিফাইড চলচ্চিত্রগুলোই দেখতে পারবে। ফলে একদিকে যেমন কোনো চলচ্চিত্রই নিষিদ্ধ হলো না অপরদিকে কাঁঠালও ইচড়ে পাকলো না।
পাকলেই যে সব কিছু পরিণত হবে এমনটা যারা ভাবে তাদের ভাবনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও একটা ভিন্ন ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটালো জার্মানি চলচ্চিত্রকাররা। চলচ্চিত্রের যাত্রাপথে ফ্রান্স যেমন নিউওয়েভ বা নরতরঙ্গ ধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করে স্বতন্ত্র ধারা চালু করলো, ইতালি যেমন নিওরিয়ালিজম বা নব বাস্তবতা ধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করে নতুনভাবে নতুনকে উপস্থাপনা করলো ঠিক তেমনিভাবে ১৯২০ সালের দিককার কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে জার্মান চলচ্চিত্রকাররা একটি নতুন ভাবধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলেন যে ভাবধারাটির নাম হলো এক্সপ্রেশনিজম’ বা অভিব্যক্তি মতবাদ ।
মতবাদের ক্ষেত্রে যত মত তত পথ হলেও আমরা যারা পথের শেষে না পৌঁছে পথ সম্পর্কে শেষ কথা বলতে পারি না, আমরা যারা মতামত শুনেই মতামতের ভিত্তিতে একটা মতবাদ মনের মধ্যে পোষণ করি সেই সকল আমাদের কাছে এক্সপেশনিজম বা অভিব্যক্তি মতবাদের চলচ্চিত্রকাররা অতল সমুদ্রের জলে ডুবে থাকা ঝিনুকের মধ্যের মুক্তোর দানা।
ধরা যাক, কক্সবাজার সমুদ্রে শীতের ঠাণ্ডায় বুক পরিমাণ জলে ডুবে মা এবং ছেলে গলায় জালের রশি বেঁধে জাল টান টান করে ধরে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্দেশ্য “একটাই যদি জালে কিছু মাছ ধরা পড়ে। এই যে খণ্ড চিত্র এটি দেখে যদি একজন রিয়েলিস্টিক চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তবে সেই চলচ্চিত্রের মূল বিষয় হবে মা ও ছেলের এই স্বাভাবিক যাপিত জীবন।
অপরদিকে একজন ইমপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ঐ একই দৃশ্যকে ধারণ করে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন সেখানে হয়তো দেখা যাবে সমুদ্রের ঢেউয়ের ভোড়ে কূল ভেঙে চলেছে অর্থাৎ দারিদ্র্যের ছোবলে মা এবং ছেলের আজকের এই ভগ্নদশা।
আর একজন এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম মেকার যদি ঐ একই দৃশ্য দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তবে তিনি সেখানে দেখাবেন একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বরে কাতরানো ছেলেকে বিছানা থেকে টেনে তুলে জোর করে শীতের বরফ জমাট সমুদ্রজলে ছেলের গলায় রশি পরিয়ে নিজেও রশি পরে জাল টান টান করে ধরে রেখেছে।
মায়ের আত্মার আত্মা যে সন্তান সেই সন্তানকে এত নিষ্ঠুর কষ্ট দিতে বাধ্য হচ্ছে কোন অবস্থায় এক মা সেই অব্যক্ত কথাকে ব্যক্ত করা, সেই অতলকে খুঁজে তোলার কাজটিই করবেন এক্সপেশনিস্ট ফিল্ম মেকার।
এক্সপ্রেশনিস্ট ফিলা মেকার হিসেবে যে দুজন জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা এ সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন তাদের প্রথমজন ড. রবার্ট ওয়াইন এবং দ্বিতীয়জন হলেন ফ্রিজ ল্যাড। নির্মাতা ড. রবার্ট নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘দ্য কেবিনেট অব ড. ক্যালিগরি’। চলচ্চিত্রটি শুরুই হয় ওভার ভয়েসে ফ্রান্সিস নামের এক যুবকের বক্তব্যের সূত্র ধরে।
ফ্রান্সিস যা বলে চলে তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। ফ্রান্সিস বলতে চায় মানুষের হিপনোটিজম বা সম্মোহিত করার কথা। আমরা যেমন দেখি ভালোবাসার চূড়ান্ত পর্বে কি ছেলে কি মেয়ে কেউই যেমন অন্যের মতামত শুনতে চায় না, আজীবনের আপন বাবা-মা, ভাইবোন অপেক্ষা ভালোবাসার মানুষটার কথাই আপন বাদ-বাকি সব পর কিংবা ভালোবাসার মানুষটির কাছে পৌঁছাতে গোত্র-বর্ণ-ধর্ম-সংস্কৃতি সব যদি বিসর্জনও দিতে হয় তবু তা দিতে একপায়ে রাজি, সেই চূড়ান্ত পর্বের যে আকর্ষণ সে রকম আকর্ষণ ক্ষমতার প্রভাবে একজন অপরজন দ্বারা প্রভাবিত হয়, সম্মোহিত হয়।
ফ্রান্সিসের দেখা তেমন একজন মানুষ ড. ক্যালিগরি যিনি পাগলা গারদের পরিচালক। ড. ক্যালিগরি যাকে হিপনোটিজম করে সে এক উন্মাদ যার নাম সিজার। সিজারের বৈশিষ্ট্য সে রাতে ঘুমের ঘোরে হেঁটে চলে বেড়ায়। এই সুযোগটাকে কাজে লাগায় ড. ক্যালিগরি।
ড. ক্যালিগরির সম্মোহিত করার ক্ষমতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সিজার একটার পর একটা খুন করে চলে। এরই ধারাবাহিকতায় ড. ক্যালিগরি সিজারকে এক সময় নির্দেশ দেয় ফ্রান্সিস এবং তার বান্ধবী জেন এর মধ্য থেকে জেনকে বেছে নিয়ে হত্যা করতে। ড. ক্যালিগরির প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে সিজার সিদ্ধান্ত নেয় সে হত্যা করবে জেনকে।
জেনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে জেনকে কিডন্যাপ করে সিজার। কিন্তু কিডনাপ এক জিনিস আর শেষ পর্যন্ত মারতে মারতে মেরে ফেলা অন্য জিনিস। কারণ জেনের নারী রহস্য। বাংলার কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু শুধুই কি বলেছেন নারী জলকে আগুন আবার আগুনকে জল করতে পারে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বলা কথার বাস্তবায়ন ঘটায় জেন। জোনের মোহনীয় রূপ, হরিণী চোখের মায়া, লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে যাওয়া, ঠোঁটের আলতো শব্দচয়ন, দেহপল্লবের মাদকতায় টলে যায় থমকে যায় সিজার। সিজার যে শুধু জেনকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকে তাই নয় বরং সিজারের মনে হয় ড. ক্যালিগরির উপস্থিতিতে জেন-এর জীবন অরক্ষিত অনিরাপদ।
ফলে সিজার নিজে ঝুঁকি নিয়ে জেনকে পালানোর ব্যবস্থা করে দেয়। ঘটনার নানা পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেখা যায় সিজার এক সময় নিজেই মারা গেছে। মৃত সিজারকে দেখে বিস্মিত, হতভম্ব, বিকারগ্রস্ত ড. ক্যালিগরি প্রলাপ বকতে বকতে এক সময় নিজেই উন্মাদ হয়ে যায়।
ড. ক্যালিগরির উন্মাদনার মধ্য দিয়ে যখন চলচ্চিত্রটি শেষ হবে হবে তখন পরিচালক ড. রবার্ট ওয়াইন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু চমৎকার দৃশ্য দেখিয়েছেন। তার তা হলো এতক্ষণ ধরে যার কথার সূত্র ধরে ফ্ল্যাশব্যাকে যেয়ে চলচ্চিত্রটি দেখানো হলো সেই ফ্রান্সিস আসলে নিজেই একজন উন্মাদ।
উন্মাদ ফ্রান্সিসের প্রলাপ শুনে পাগলাগারদের পরিচালক ড. ক্যালিগরির নিশ্চিত সিন্ধান্ত ফ্রান্সিসকে সারিয়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। মানবমনের রহস্য উদ্ঘাটন এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির নান্দনিক দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র দ্য কেবিনেট অব ড. ক্যালিগরি।
দ্য কেবিনেট অব ড. ক্যালিগবির কারিশমায় পরিচালক ড. রবার্ট ওয়াইনের যেমন খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তেমনিভাবে ম্যাট্রোপোলিস’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করায় এক্সপ্রেশনিজম মতবাদের চলচ্চিত্রকার হিসেবে ফ্রিজ ল্যাঙ-এর খ্যাতিও তখন বিশ্বব্যাপী।
বাংলাদেশে পরিচালকসত্তা নিয়ে জহির রায়হান যেমন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ঠিক তেমনভাবে সমগ্র জার্মানির সর্বজনশ্রদ্ধেয় পরিচালক ফ্রিজ ল্যান্ড। পরিচালক ফ্রিজ ল্যান্ড-এর চলচ্চিত্র ম্যাট্রোপোলিসের মূলদ্বন্দ্ব মালিক এবং শ্রমিকদের নিয়ে।
ধরা যাক আজকের ২০১০ সালে দাঁড়িয়ে কোনো এক পরিচালক ৩০০০ সালের পৃথিবীর কথা ভাবনায় রেখে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন যেখানে ফুটে উঠেছে ৩০০০ সালের মালিক এবং শ্রমিকদের সম্পর্ক তবে ব্যাপারটা যেমন হয় পরিচালক ফ্রিজ ল্যান্ড এর নির্মিত চলচ্চিত্র ম্যাট্রোপোলিসের ঘটনাও ঠিক সে রকম।
১৯২৭ সালে দাঁড়িয়ে ২০০০ সালের পটভূমিতে এক শিল্পনগরীর কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় শিল্পপতি মালিকের কারণে শ্রমিকরা সব ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। যন্ত্র চালাতে চালাতে শ্রমিকরা এক সময় যেমন নিজেরাই যন্ত্রে পরিণত হয় ঠিক তেমনি ধারাবাহিক লাঞ্ছনা-বঞ্চনার কারণে অমানবিক জীবন কাটাতে কাটাতে শ্রমিকরা অসাড় হয়ে পড়ে।
আমকে পেষণ করলে যেমন রস বের হয় এবং রস যে খায় সে যেমন পুষ্টিলাভ করে অনেকটা। সে রকমভাবে ক্রীতদাসরূপী শ্রমিকদের শ্রমকে নিংড়ে রস আস্বাদন করে। মালিক পক্ষ এবং লাভবানও হয় মালিক পক্ষ। কিন্তু কথায় বলে দস্যুকুলে।
বাড়ে প্রহ্লাদ। অনেকটা প্রহ্লাদের মতো মালিক ছেলে মালিকের নৃশংসতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের প্রতিনিধি এক শ্রমিক নেত্রীকে সঙ্গে করে শ্রমিক পক্ষ হয়ে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তোলে। বিদ্রোহ খানিকটা সফল হলেও শ্রমিক পক্ষের কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতাকে সম্বল করে মালিক পক্ষ বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয়। পুনঃমালিক পক্ষ এবং শ্রমিক পক্ষের মধ্যে মনিব-ক্রীতদাস সম্পর্কের আবহমান ধারা অব্যাহত রেখে শেষ হয় চলচ্চিত্র ম্যাট্রোপোলিস ।
ম্যাট্রোপোলিস চলচ্চিত্র নির্মাণের শেষদিকে জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নির্মাণ আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এর প্রধান ভাগে আছে আর্নেস্ট লুবিচ। আর্নেস্ট লুবি-এর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র আমেরিকায় বাজার ছুঁয়ে বিশ্বব্যাপী পরিবেশিত হয়।
আর্নেস্ট লুব্যি-এর ‘রোজিটা’ চলচ্চিত্রটি একজন গায়িকার বেড়ে ওঠার জীবনকাহিনী। রোজিটাই তাদের দরিদ্র পরিবারের একমাত্র আয়ক্ষম। দরিদ্রতার অন্যতম কারণ যে রাষ্ট্রের দুর্বলতা সেই বিষয়কে উপজীব্য করে রাজার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে রোজিটা গান গাইলে, রাজা রোজিটাকে শাস্তি দেয়ার জন্য সভায় ডেকে পাঠায়।
প্রহরীরা রোজিটাকে ধরতে গেলে ডন ডিয়েগো নামের এক ক্যাপ্টেন বাধা দিতে এসে নিজেও কারারুদ্ধ হয়। কারাগারেই রোজিটা এবং ডন ডিয়োগের মধ্যে ভালোবাসা জন্ম নেয়। রোজিটাকে দেখে রাজা শাস্তি ভুলে প্রণয় নিবেদন করলেও প্রকৃত ভালোবাসা যে কোনো অবস্থায় কোনো প্রলোভনকে গ্রহণ করে না সেটাই বোঝা যায় ডন ডিয়োগের হাত ধরে রোজিটার বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে।
রোজিটা চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে জার্মান চলচ্চিত্রকারদের আমেরিকা জয়ের ধারাবাহিকতায় অপর এক সফল জার্মান চলচ্চিত্রকার হলেন ফ্রেডরিক উইলহেলম মুরনাউ । মুরনাউয়ের চলচ্চিত্র ‘সারাইজ : এ সং অব টু উইমেন’- এ দেখা যায় স্বামী কৃষক আনসেস তার স্ত্রী ইন্দ্রিকে অপর এক প্ররোচনাকারী নারীর কারণে হত্যা করতে পরিকল্পনা করেছে।
নদীর পাড়ে নিয়ে স্ত্রী ইন্দ্রিকে হত্যা করাই আনসেসের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্যের কারণ অপর এক নারীকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়ার ক্ষেত্রে আনসেসের ইচ্ছা পূরণে পথের কাঁটা ইল্লি। অনেক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এক সময় আনসেসের মনে হয় পৃথিবীর অন্য যে কোনো নারী অপেক্ষা স্ত্রী ইন্দ্রাই তার সব থেকে আপন।
হত্যার মতো ঘূণিত পথ থেকে ফিরে ভালোবাসার জয়রথে চড়ে আনসেন ও ইন্দ্রির মিলনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘সানরাইজ এ সং অব টু উইমেন’। মুরনাউয়ের চলচ্চিত্র ‘সিটি গার্ল’-এ দেখা যায় কৃষক লেম শিকাগো গিয়েছে মিনোসোটা থেকে উৎপাদিত গম বিক্রি করতে। শিকাগোতে যেয়ে পরিচারিকা কেটকে দেখে লেমের ভালো লাগা, ভালোবাসা এবং বিয়ে।

স্ত্রী কেটকে নিয়ে লেম বাড়ি মিনোসোটাতে ফিরলে নববধূ কেটকে দেখে লেমের মা এবং বোন খুশি হলেও বিরক্ত লেমের বাবা। লেমের বাবার একান্ত বিশ্বাস সম্পদের লোভেই লেমকে বিয়ে করেছে কেট। স্বামী লেমের চাষাবাদে স্ত্রী কেট অংশ নিলে লেমের বাবার সন্দেহ আরো বাড়ে। বাবার কারণে লেম ও কেটের মধ্যে দ্বন্দ্ব। বাড়তে থাকলে বীতশ্রদ্ধ কেট এক সময় স্বামীর ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করে।
কেটের চলে যাওয়া দেখে এক সময় লেমেরও চেতনা ফিরে আসে এবং ব্যাকুল হৃদয়ে লেম কেটকে অনুসরণ করে। শহুরে মেয়ের গ্রামীণ স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘সিটি গার্ল’। মুরানাউ এর জীবনের শেষ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘টাবু : এ স্টোরি অব দ্য সাউথ সিজ’।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এক জেলে, নাম মাতাহি। মাতাহি ভালবেসে ফেলে রেরি নামের এক দেবদাসীকে। দেবদাসীদেরকে বলা হয় টাবু। সম্প্রদায়গত ঐতিহ্যের কারণে দেবদাসীদের চিরকুমারী থাকাটাই নিয়ম। প্রয়োজন যেমন বাঁধ মানে না তেমনি মাতাহি এবং বেরি ভালোবাসাকে অর্থবহ করে তুলতে শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত একটি দ্বীপে পালায়।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহানের মতো করে শেতাঙ্গদের দ্বীপে যেয়ে মাতাহি এক চীনা দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পড়ে পড়ে সর্বস্ব হারায়। চীনা দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পড়ে পড়ে মাতাহিকে রেরিকে সঙ্গী করে অন্য একটি দ্বীপে যেতে হয়। সেই দ্বীপে টাবু সম্প্রদায়ের প্রধান হিতু রেরিকে নিয়ে আসে।
হলিউড অভিনেতা টম হ্যাংকস অভিনীত কাস্ট অ্যাওয়ে চলচ্চিত্রে টম হ্যাংকস যেমন চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত এক নির্জন দ্বীপে একাকী বাস করতে থাকে অনেকটা সেরকমভাবে হাঙ্গর আক্রান্ত মৃত্যুভয়ে সন্ত্রস্ত কুলহীন কিনারহীন সমুদ্রে ভাসমান মাতাহির গন্তব্যহীন একাকীত্বের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘টাবু এ স্টোরি অব দ্য সাউথ সিজ।
সাউথ সিজ কি আর নর্থ সি কি ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির ক্ষমতায় এসে অ্যাডলফ হিটলার সমস্ত পৃথিবীটাই দখলের স্বপ্নে মেতেছিলেন। হিটলারের ক্ষমতায় আরোহণ জার্মান চলচ্চিত্রের উপর সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৩৩ সালেই আত্মপ্রচারকে সামনে রেখে হিটলাকের
গণশিক্ষাদান এবং স্বপ্রচারবিষয়ক অধিদপ্তরের মন্ত্রী ড. যোসেফ গোয়েবেলস প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টেট চেম্বার অব কালচার’। এ প্রতিষ্ঠানটি সামগ্রকিভাবে ছিল আর্ট, মিউজিক, থিয়েটার, লেখক, প্রেস, রেডিও এবং চলচ্চিত্রের জন্য।
চলচ্চিত্রের জন্য প্রতিষ্ঠান হলেও একটি চলচ্চিত্রের স্বাভাবিক নির্মাণে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হলো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। আদর্শ ও ভাবগত কারণে নাৎসিবাহিনীর সাথে যেসব জার্মান চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, টেকনিশিয়ান, লেখক, অভিনেতাসহ কলাকুশলীর মতপার্থক্য তৈরি হলো তারা সবাই একে একে স্বদেশ-স্বভূমি ছেড়ে পরদেশে পাড়ি জমালো।
ফলে চলচ্চিত্র অঙ্গনে গুণী নির্মাতাদের অভাবে চলচ্চিত্রে দীনতার ছায়া ফুটে উঠলো। অন্যদিকে কাজ যতই মহৎ হোক না কেন মহৎ কাজসম্পন্ন মানুষটিই যদি নিজে নিজের গুণ গাওয়া শুরু করে তবে মানুষটির প্রতি যেমন আস্তে আস্তে বিরক্তি লাগা শুরু করে জার্মান চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে হলোটাও তাই। চলচ্চিত্রের মধ্যে যখন সরকারি প্রশস্তিই একমাত্র প্রচার হতে থাকলো তখন খুবই স্বাভাবিক কারণে চলচ্চিত্রের গতিও হ্রাস পেল।
হ্রাস পেলেও দু-একটি চলচ্চিত্র এই সময়টাতে জার্মানিতে আলোড়ন তোলে। যেমন ১৯৩৫ সালে জার্মান পরিচালক ইউকিকি নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘দাস মেডচন যোহানা (জোয়ান দ্য গার্ল)’। চলচ্চিত্রটি বার্লিনে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কংগ্রেসে প্রদর্শিত হয়।
সবার মনে হয় চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র জোয়ান আসলে অ্যাডলফ হিটলারের কাহিনীচরিত্র। এ চলচ্চিত্রে স্পষ্টতই দেখানো হয় দেশের নৈরাশ্য এবং দৈন্য থেকে টেনে তুলছে দেশপ্রেমিক নেতা জোয়ান এবং জোয়ান যে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারছে নিজের বীরত্ব দ্বারা সেই বীরত্বের একমাত্র রহস্য জোয়ান দেশকে ভালোবাসে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে।
ভালোবেসে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যার বদলা নিতে যেয়ে জার্মানি জড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন থেকে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানি জাতির গলায় জোটে ভার্সাই চুক্তির মতো কাটার মালা।
একদিকে খণ্ড-বিখণ্ডের জার্মানি, একদিকে যুদ্ধাপরাধীর কলঙ্কের তিলক, একদিকে বছর শেষে ক্ষতিপূরণ দিয়ে চলা আবার বিজয়ী রাষ্ট্রের খবরদারি মাথা পেতে নেয়া। জার্মানি এমনিতেই তেতে ছিল। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং নানা অসঙ্গতির কথা বিবেচনায় এনে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে জার্মানি।
১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানি। ি বিভক্ত জার্মানি। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী পূর্ব জার্মানি, অপরদিকে আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স সমর্থিত ধনতন্ত্রে বিশ্বাসী পশ্চিম জার্মানি।
জার্মানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত পূর্ব জার্মানিতে পড়ে। পূর্ব জার্মানির চলচ্চিত্র বিকাশে সোভিয়েত ইউনিয়ন যতটা নমনীয় পশ্চিম জার্মানির চলচ্চিত্র বিকাশের ক্ষেত্রে আমেরিকা-ব্রিটেন ততটাই ধীর গতিসম্পন্ন।
উপরন্তু আমেরিকা এবং ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে যার যার তার তার মতো করে চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টার ফলে জার্মানিতে প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন এবং প্রজেক্টশনদের মধ্যে যে অখণ্ড সম্পর্ক ছিল সেই অখণ্ড সম্পর্কের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল তোলা হয়। ফলে জার্মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই খণ্ডায়ন জার্মান চলচ্চিত্রাঙ্গনকে আরো দুর্বল করে তোলে।
দুর্বল জার্মান চলচ্চিত্রাঙ্গন আরো দুর্বল হয়ে পড়ে যখন আমেরিকা অফিস অব ওয়ার ইনফরমেশন ওভারসিজ মোশন পিকচার ব্যুরো (ওডব্লিউআই) সংস্থা স্থাপন করে এবং জার্মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে ওডব্লিউআই-এর অধীনে নিয়ে আসে। মূলত নাৎসিবাহিনী কত বিপজ্জনক ছিল, জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত ভয়ঙ্কর ভূমিকা রেখেছে, প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে ঠিক কি বোঝায় এ রকম জার্মান দেশে জার্মানবিরোধী বিষয় এবং শিক্ষামূলক বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো।
মীর জাফরের মতো লোক যেখানে লর্ড ক্লাইভকে বলতে পারে আমি বিশ্বাসঘাতক নই অথচ ইতিহাসের সেরা বিশ্বাসের ওপর ঘাতকের মতো বুলেট ছুঁড়েছে নবাবের সাথে বেঈমানী করে তাতে তো এটা স্পষ্ট অন্যায় করলেও অন্যায়কারী নিজেকে অন্যায়কারী ভাবতে চায় না। ফলে যুদ্ধোত্তর জার্মানিবাসী যুদ্ধ চলাকালীন তাদের নেতিবাচক ভূমিকা দেখার উপর আগ্রহ হারাবে এটাই স্বাভাবিক এবং সহজ ব্যাপার। ফলে জার্মান চলচ্চিত্র তার দর্শক হারায়।
উপরন্তু চলচ্চিত্র শিল্পে কাঁচামালের সঙ্কট, অর্থ মন্দার কারণে প্রযোজকদের লগ্নির অভাব, প্রযোজকদের প্রতিষ্ঠানে জার্মান ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়া বন্ধ করে। দেয়া, ক্ষুদ্র প্রযোজকদের অর্থলগ্নির শর্ত শিল্প অপেক্ষা বাণিজ্যিক মুনাফা লাভ, নিত্যনতুন প্রযুক্তি কৌশল থিম নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে অনীহা প্রভৃতি কারণ মিলেমিশে জার্মান চলচ্চিত্র এই সময়ে খানিকটা স্থবির হয়ে পড়ে।
স্থবির হয়ে পড়া মানেই চলা বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। সেটা বোঝা যায়। জার্মান প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও জার্মান চলচ্চিত্রকারদের ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্য পৌঁছে দিয়ে যারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম বাভারিয়া ফিল্ম, কনস্টান্টিন ফিলা, স্টুডিও হ্যামবার্গ এবং ইউএফএ। সম্প্রতি বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যেগুলো বহু প্রদর্শিত এবং বহু দর্শকনন্দিত। যেমন পরিচালক টম টাইকারের চলচ্চিত্র ‘রান লোলা রান’ ।
‘রান লোলা রান’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র লোলার বয়ফ্রেন্ড একটা গ্যাং লিডারের সঞ্চিত অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বয়ফ্রেন্ডটি সঞ্চিত অর্থ ফিরিয়ে দিতে না পারে তবে গ্যাং লিডারের হাতে বয়ফ্রেন্ডটির মৃত্যু নিশ্চিত। নিরুপায়, ভীতু বয়ফ্রেন্ডটি সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ায় লোলার দিকে। বয়ফ্রেন্ডের ডাকে সাড়া দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে তিনটি পথ বেছে নেয় লোলা।
প্রথম পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোলা এবং বয়ফ্রেন্ড ব্যাংক ডাকাতি করে অর্থ যোগাড় করে কিন্তু পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে বয়ফ্রেন্ডটি মারা যায়।
দ্বিতীয় পথে লোলা বাবার কাছে টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয় । লোলার বাবা রক্ষিতার জন্য অর্থ ব্যয় করে অথচ ভাবি মেয়ের জামাইয়ের কথা বিবেচনা করে অর্থ সাহায্য না করলে বাবার কপালে মেয়ে লোলা বন্দুক ঠেকিয়ে হবু স্বামীর প্রয়োজনীয় অর্থ আদায় করে ফিরতে থাকে। চঞ্চলা, পলায়নরতা লোলা ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্ট করে মারা পড়ে।
তৃতীয় পথে লোলা জুয়ার আসরে জুয়া খেলে অর্থ জিতে প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে ফেরে। এসব সম্ভাব্য ঘটনার মাঝে বয়ফ্রেন্ডটির অর্থ এক ভিখারী যে না বুঝে নিয়েছিল সে যখন বুঝল তখন ফেরত দিতে এল। বয়ফ্রেন্ডটি হারানো অর্থ হাতে পেয়ে গ্যাং লিডারকে ফেরত দিয়ে সে যাত্রা বাছলো।
কিছু আগেও অর্থ পাওয়ার জন্য মরিয়া যে বয়ফ্রেন্ড সে যখন লোলার হাত থেকে অর্থ পেল সেটা একটা সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু পরিচালক বোঝালেন প্রকৃত ভালোবাসার ক্ষেত্রে একজন প্রেয়সী তার প্রেমিককে বাঁচাতে প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিতেও একবারের জায়গায় দুবার ভাবে না।
ভাবনায় যা না তাও তো মানুষকে জীবনের কোনো না কোনো পর্বে ভাবতে হয় । মানুষের ভাবনার জগতের বিশ্বাসও তো কোনো না কোনো সময় কাচ পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে যাওয়ার মতো করে ভেঙে যায়। তেমনি মানুষের বিশ্বাস, স্বপ্ন এবং ঐতিহ্যের ভাঙ্গন নিয়ে জার্মান পরিচালক উলফ গ্যাঙ বেকার নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘গুড বাই লেনিন’ ।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন মা, যার নাম ক্রিস্টেন। মা ক্রিস্টেনের স্বামী রবার্ট থাকেন পশ্চিম জার্মানিতে। মা ক্রিস্টেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং সে কারণেই এক ছেলে অ্যালেক্স এবং এক মেয়ে এরিয়েনকে নিয়ে থাকেন সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় বিশ্বাসী পূর্ব জার্মানিতে। সমাজতন্ত্র এবং ধনতন্ত্র দুই ভাবধারার দুটি বিশ্বাস ক্রিস্টেন এবং রবার্টকে আলাদা করেছে।
চলচ্চিত্রের একটি জায়গায় এসে দেখা যায় মা ক্রিস্টেন অসুস্থজনিত কারণে কোমাচ্ছন্ন। এই কোমাচ্ছন্ন অবস্থাটা চলে ১৯৮৯ সালের আট মাস যে আট মাসের সময়টায় দুই জার্মানি মিলে যাবে যাবে ভাব। পূর্ব জার্মানির সমাজতন্ত্রে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে ক্যাপিটালিজ। কোকাকোলা ঢুকছে, মুক্তবাজারের ছায়া পড়ছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে, প্রতিযোগিতা বাড়ছে, লোভ-হিংসা বাড়ছে, ভোগ্যপণ্যের নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হচ্ছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মহত্যা ও যৌন অধিকারের চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা বাড়ছে।
পূর্ব জার্মানির সমাজতন্ত্র যখন বিলুপ্তপ্রায় ঠিক তখন একদিন কোমা থেকে মুক্ত হয় ক্রিস্টেন। মা ক্রিস্টেনকে সুস্থ পেয়ে মেয়ে এরিয়েন যখন ক্যাপিটালিজমের জয়গাথা মাকে শোনানোর জন্য ব্যাকুল ঠিক তখন ছেলে অ্যালেক্স আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মায়ের বিশ্বাসকে বিশ্বাসের জায়গায় ধরে রাখতে।
মায়ের চোখ যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত ছেলে অ্যালেক্স কমিউনিজমের চাদর পেতে পরিবর্তিত ক্যাপিটালিজমকে ঢেকে রাখতে মরিয়া। যেমন কোমার আগে মা ক্রিস্টেন যে বোতলে জল খেত সেই বোতলটি হয়তো ছিল কাচের বোতলের।
কিন্তু ক্যাপিটালিজমের সময় এসে সেই বোতলটাই হয়ে গেল প্লাস্টিকের “ওয়ানটাইম ইউজ, ইউজ এন্ড থ্রো। এক্ষেত্রে ছেলে অ্যালেক্স যেটা করে সেটা হলো ক্যাপিটালিজমের জলের বোতল টাকা দিয়ে কিনে মায়ের চোখের আড়ালে কমিউনিজমের সময়ের বোতলে ঢেলে মাকে পান করাতো। ফলে বাহ্যিক পরিবর্তন হয়ে গেলেও মা ক্রিস্টেনের মনের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস, ভাব ও আদর্শ অটুট ছিল।
কিন্তু একদিন মা ক্রিস্টেন পথ দিয়ে হাঁটার সময় দেখেন, হেলিকপ্টার দড়ি দিয়ে লেনিনের পাথরের মূর্তি বেঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলে অ্যালেক্সের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মা ক্রিস্টেন বোঝেন, সমাজতন্ত্রের দিন শেষ। ক্ষমতা পালাবদলের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘গুড বাই লেনিন’।
লেনিনকে গুড বাই জানালেও ভাবার কোনো কারণ নেই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গা ভাসিয়ে জার্মান চলচ্চিত্রকাররা শুধু আমেরিকামুখী যাত্রা করেছে। বরং ইউরোপের অনেক দেশের অনেক চলচ্চিত্রকার জার্মানিতে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জার্মান চলচ্চিত্রের মূল স্রোতে মিশে নিজেদেরকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
এই যেমন তুরস্কে বেড়ে ওঠা জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া চলচ্চিত্রকার ফেইথ একিন । ফেইথ একিন নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘হেড-অন’। হেড-অন চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র ব্যাসে চল্লিশ ঊর্ধ্ব তুরস্ক নাগরিক কেইথ। পুরুষের দাম্পত্য জীবনে চল্লিশ এমনই একটা বয়স যখন স্ত্রীকে শুধু রক্তমাংসের শরীর না ভেবে স্ত্রীর শরীরের মধ্যে লুকায়িত মনকে আবিষ্কার করে সেই মনের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে শুরু করে।
কেইথ যখন তার স্ত্রীর ভালোবাসার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ঠিক সেই সময় কেইথের স্ত্রী আজীবনের মতো চোখে বুজলেন যে চোখ একবার বুজলে আর খোলে না। স্ত্রীবিহীন কেইথ বেঁচে থাকার মানে হারালো। কার জন্য কিসের জন্য তার এই বেঁচে থাকা। কিন্তু ঐ যে বলে মানুষ অবলম্বন ছাড়া বাঁচতে পারে না। কেইথ জার্মানিতে এসে অবলম্বন ধরলো তবে সে অবলম্বন ড্রাগ, অ্যালকোহল, কোকেন।
ড্রাগ নিলেই মাথা ভারী হয়, পা টলে যায়, চোখের পাতায় সরষের ফুল দেখা যায়, বাতাসে মিশে যেতে ইচ্ছা হয়। মাতলামোর একপর্যায়ে কেইথ রোড এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি হয়। হসপিটালে কেইথের সাথে পরিচয় হয় সিভেল নামে জার্মানিতে অস্থায়ীভাবে বসবাসরতা এক নারীর।
সিন্ডেলের অপরাধ সে তুরস্কের সংস্কৃত-ঐতিহ্য ভুলে এক জার্মান ছেলেকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। ফলে সিভেলের বড় ভাই সিভেলকে মেরে সিভেলের নাক ভেঙে দিয়েছে যে কারণে সিভেল হসপিটালে ভর্তি হয়। আগুন জ্বললে পাশে থাকা ঘি যেমন গলতে থাকে ঠিক তেমনি কেইথের উপস্থিতিতে সিভেলের মনও নরম হওয়া শুরু করে।
দুজন দুজনকে ভালোবাসে আবার দুজনই চায় স্বাধীন জার্মানিতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে। ফলে তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করে কেউ কারো উপর খবরদারি করবে না আবার যেহেতু একজনকে না দেখে অপর জনের অপেক্ষায় স্থির হয়ে থাকা সম্ভব না তাই তারা একই ছাদের তলে লিভ টুগেদার হয়ে বসবাস করবে। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ।
পাশাপাশি বসবাসে দুজন দুজনার কত যে আপন হয়ে গেছে সেটা বোঝা যায় যখন এক গুণ্ডা যুবক সিভেলকে বিরক্ত করে তখন কেইথ গুণ্ডাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু একি গুণ্ডাটা তো মরেই গেল । যথারীতি জার্মান আইনে কেইথের জেল।
বন্দী কেইথ মুক্ত সিভেল তবু কেইথহীন সিভেলের কিছুই ভালো লাগে না। সিডেল ফিরে আসে তার স্বভূমি। তুরস্কে। সিলেভবিহীন কেইথের বিনিদ্র রাত বিনিদ্র দিন। যেদিন কেইথ জেল থেকে মুক্ত হয় সেদিনই কেইথ সিভেলকে খুঁজে পেতে রওনা দেয় তার স্বদেশ তুরস্কে।
ভালোবাসার ব্যাকুলতার জয়ধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘হেড-অন’। স্বদেশ স্বভূমিকে বুকের মধ্যে লালন করায় জার্মান-তুরস্ক পরিচালক ফেইথ একিনের হেড-অন যেমন বরাবরের মতো উঁচু ঠিক তেমনি বর্তমানে গণতান্ত্রিক চর্চার পাদপীঠ হিসেবে জার্মানির মাথাও উঁচু।
মাথা উঁচু করে বাঁচবে মানুষ, মানুষ বাঁচবে মানুষের জন্য। রাষ্ট্রী ব্যবস্থায় মুনাফালোভী পুঁজিবাদের বিলোপ ঘটবে। সমস্ত কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করা হবে। কৃষিব্যবস্থা চলবে সমবায়ের ভিত্তিতে। মানুষের শ্রম শুধু নিজের ভরণপোষণের জন্য নয় বরং রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য। বিনিময়ে রাষ্ট্র মানুষকে দেবে জীবিকা, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সমান সুযোগ এসবই কমিউনিজমের মহৎ ভাব ও আদর্শ।
কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যক্তি অপেক্ষা দল বড়। পার্টির কাউন্সিলে ব্যক্তি, দলের ভূমিকা, কার কি অবস্থান সেসব নিয়েই নিয়মিত কাউন্সিলিং হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পশ্চিম বাংলায় বর্তমান সময়ের একটি বহুল আলোচিত নাটক ‘রুদ্ধসংগীত”।
ব্রাত্য বসুর রচনা ও নির্দেশনায় বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে জন্ম নেয়া ভারতখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের সংগীত জীবন কিভাবে পথে পথে হয়েছে বাধাগ্রস্ত সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে নাটক ‘রুদ্ধসংগীত’। ‘রুদ্ধসংগীত নাটকের একটা দৃশ্যে দেখা যায় চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পিছনে পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গোয়েন্দা লাগিয়েছে পাছে ঋত্বিক ঘটক কমিউনিস্ট পার্টির বিপক্ষে কোনো কাজ করছে কি না তা তদন্ত করে দেখার জন্য।
বিষয়টা যেন অনেকটা সে রকম ২০০৭ সালে ৭৯তম অস্কার (বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম) পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান পরিচালক ফ্লোরিয়ান হ্যাঙ্কেল ভন ডোনারসমার্ক নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য লাইভস অব আদার’।
দ্য লাইভস অব আদারস চলচ্চিত্রের সময়টা ১৯৮৪ সাল যখন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকার ক্যাপিটালিজমের ধাক্কায় খানিকটা নড়বড়ে। সলতে প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে যমন ধপ করে জ্বলে উঠে ঠিক তেমনি পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকার নিজেদের প্রশাসন, পুলিশকে আরো বেশি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্যাপ্টেন জার্ড উইলার কমিউনিস্ট পার্টির একান্ত অনুগত। অনুগত জার্ড উইলারকে পার্টির তরফ থেকে একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্বটা হলো জার্মান নাট্যকার জর্জ ডেইম্যান এবং তাঁর বান্ধবী সেরা অভিনেত্রী ক্রিস্টা মারিয়া সিল্যান্ড যে দল বা পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করছে সে রকম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নথিপত্রসহ দলের কাছে প্রমাণ পেশ করা।
জার্ড উইলার যখন তদন্ত কাজে কোমর পরিমাণ জলে নেমে গেছে তখন পার্টির নাট্যকার এবং তার অভিনেত্রীর বান্ধবীর তদন্ত কাজ বন্ধ করে দেয়। জার্ড উইলারকে ডেকে পাটি তার নির্দেশও দিয়ে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে জার্ড উইলারের তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার কাজ থেকে ফিরে আসতে গভীরভাবে অনীহা।
জার্ড উইলারের বিশ্বাস, তীর একবার বেরিয়ে গেলে, মুখ থেকে কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা আর ফেরে না। ফলে জার্ড উইলার তার গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে যায়। দলের নির্দেশ অমান্য করেই। ফলে পার্টি এবং পার্টি অনুগত জার্ড উইলারের মধ্যে শুরু হয় এক নতুন গেম। বিভিন্ন অবস্থায় মানুষ যে বিভিন্ন রূপধারণ করে সেসবের প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র ‘দি লাইভস অব আনারস’।
*দি লাইভস অব আদার’ চলচ্চিত্রটি যেমন অস্কার পুরস্কার লাভ করেছে। ঠিক তেমনিভাবে অস্কারের জন্য ২০০৬ সালে বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্যাটাগরিতে মনোনীত জার্মান চলচ্চিত্রকার মার্ক রোধেমান্ডের নির্মিত চলচ্চিত্র সোফিস্কল- দ্য ফাইনাল ডেজ।
ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেরের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন ভূমিকা অনেকটা সে রকম ভূমিকা নাৎসিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া নারী নেত্রী সোফি স্কুল এর। নাসি জামানায় নাৎসিবিরোধী পার্টি দ্য হোয়াইট রোজ।
সোফি স্কল দা হোয়াইট রোজ পার্টির নিবেদিত কর্মী এবং নেত্রী। সোফি কলের জীবনের ঘটে যাওয়া ১৯৪৩ সালের ঘটনা অবলম্বনে কাহিনী চলচ্চিত্র ‘সোফি স্কল দা ফাইনাল ভেজ’। যে কোনো দেশে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হানাদার বাহিনী যেমন স্বাধীনতাকামীদের খুঁজে খুঁজে বের করে, ঠিক তেমনিভাবে নাৎসিবাহিনী দ্য হোয়াইট রোজদলের সোফি স্কলকে ধরে ফেলে এবং প্রহসনমূলক বিচারের সম্মুখীন করে।
স্বাধীনতাকামী সোফি স্কল নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে, নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, পার্টির গোপনীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখে নাসি বিচারকদের চোখে প্রায় ধুলো দিয়ে ফেলেছিল কিন্তু ভাই হানসের সরলতা, ভীত হয়ে সত্য কথা বলে ফেলায় সোফি স্কল শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায় ফলে সোফি স্কলের উপর নেমে আসে নাৎসিবাহিনীর মর্মান্তিক মৃত্যুদণ্ড সোফি স্কলের মর্মান্তিক কাহিনীর পরিণতির চলচ্চিত্র ‘সোফি ফল দ্য ফাইনাল
ফাইনাল ডে হোক আর ফাইনাল ডেজ হোক চূড়ান্ত মুহূর্ত এক না এক সময় মানুষের জীবনে আসে। সেসব মুহূর্ত নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র সংখ্যাও হাতেগোনা কম নয়। যেমন যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুর পূর্বের শেষ বারো ঘণ্টার প্রেক্ষাপট নিয়ে আমেরিকার মেলগিবসন নির্দেশিত এবং অভিনীত চলচ্চিত্র ‘দ্য প্যাশন অব ক্রাইস্ট’।
ঠিক তেমনি অ্যাডলফ হিটলারের জীবনের শেষ সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে অলিভার হার শোবিখেলের চলচ্চিত্র ‘ডাউন ফল আমেরিকা চলচ্চিত্র ‘হিটলার: দি রাইজ অব ডল’-এ যে অ্যাডলফ হিটলারের শৈশবের বেড়ে ওঠা, কৈশোরের তারুণ্য, যৌবনের যুদ্ধাভিযান প্রভৃতি দেখানো হয়েছে ঠিক তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের যখন পতন ঘটতে যাচ্ছে ঠিক তখন হিটলার ।
এডাব্রাউনের অবস্থান, যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ক্ষীণ চিন্তা কিন্তু পরাজয়কে নিশ্চিত মেনে নিতে হিটলারের দমবন্ধ দশা, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত না থামিয়ে দেয়া উচিত ভাবনা, না কি যুদ্ধক্ষেত্র ফেলে পালিয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা কিংবা পালানো অপেক্ষা আত্মহত্যাই শ্রেয় বলে শেষ সিদ্ধান্ত টানা প্রভৃতির প্রেক্ষাপট নিয়েই চলচ্চিত্র “ডাউন ফল’ শেষ হয়।
শেষ হয়ে গেলে নতুন কিছুর যে শুরু হবে না এটা কেউ বলতে পারে না। অতীত শেষ হয়ে গেছে, ভবিষ্যৎ এক না এক সময় আরম্ভ হবে কিন্তু যেটি বর্তমান সেই বর্তমানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানলে যে ফলাফলে মানুষ লাভবান হয় সেই বাস্তবতা নিয়ে অস্কারে বিদেশী চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনীত জার্মান চলচ্চিত্রকার ক্যারোলিন লিউক নির্মিত চলচ্চিত্র ‘বিয়ন্ত সাইলেন্স’।
বিয়ন্ড সাইলেন্স চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র লারার মা এবং বাবা বধির। কিশোরী লারা সংসারে সব কাজ করার পাশাপাশি বাবা-মাকে দেখে রাখে। ফোন ধরা, রান্না করা, গোসল করানো, নিজে সব সাংসারিক কাজ করতে যেয়ে লারার স্কুলের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। কিন্তু লারার ধ্যান-জ্ঞান ভালোবাসা সংগীতের প্রতি। লারার মা সংগীতের প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগী না হলেও লারার বাবার সংগীতের প্রতি রয়েছে প্রচণ্ড বিরাগ।
বিরাগের কারণ লারার বাবার শৈশবের অভিজ্ঞতা। শৈশবে লারার বাবা বধির হওয়ায় যেমন সকলের কাছে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রয়োজনীয়, অনাদরের পক্ষান্তরে লারার বাবার বোন সংগীতের ইনেস্ট্রুমেন্টে সুরের মূর্ছনা তুলে সবার কাছে হতো কাঙ্ক্ষিত, প্রয়োজনীয় এবং আদরের।
যে সংগীত ভাই এবং বোনকে দুটি আলাদা স্তর করে দিয়েছিল, যে সংগীতের অভাবে একজন হয়ে যায় মূল্যহীন অপরজন হয়ে ওঠে মূল্যবান সেই সংগীতকে যে লারার বাবার অপছন্দ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আর আজ এত বছর পরে এসে যদি সেই সংগীতপ্রতিভা নিজের মেয়ে লারার মধ্যে প্রকাশিত হয় তবে চূড়ান্ত বিরক্ত না হয়ে আর উপায় আছে।
বিরক্তির মাঝে বিরক্তি আরো বাড়ে যখন লারার বাবার বোন লারাকে একটা মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট গিফট করে। মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট হাতে পেয়ে লারা মন-প্রাণ ঢেলে গানের ভুবনে সাধনায় নিমগ্ন হয়। এরই এক পর্যায়ে সংগীতে দক্ষতার কারণে লারার সামনে সুযোগ আসে বার্লিন একাডেমিতে ভর্তি হবার।
প্রতিমধ্যে হঠাৎ দুর্ঘটনায় লারার মা মারা গেলে লারার বাবার জীবনে একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় লারা। লারার সংগীত প্রেম লারার বাবার অপছন্দ অথচ একাকিত্বের জীবনে বাঁচার অবলম্বন লারা। অপরদিকে লারা চায় সংগীতসত্তা নিয়ে ভর্তি হতে বার্লিন একাডেমিতে এবং সংগীত-আকাশে নিজেকে মেলে ধরতে।
একদিকে বাবার নিষেধ অপরদিকে লারার একান্ত ভালোবাসা। বাবা কন্যার এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত লারা এগিয়ে চলে বার্লিন একাডেমির সংগীতজগতে। জগৎসভায় জার্মান চলচ্চিত্রের অবস্থাটাও অনেকটা লারার বাবা এবং লারার মধ্যকার টানাপোড়েনের মতো। বাবার মতো নেতিবাচক চরিত্রের ভূমিকায় জার্মানির পরপর দুবার বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। লারার মতো সম্ভাবনাময় চরিত্রে আস্ত জার্মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।
একদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চলচ্চিত্র শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা, অপরদিকে বড় বড় লগ্নির বাজেট এসে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রেরণা যোগানো আবার ফ্রেঞ্চ-ইতালির বড় বড় ফিল্ম প্রডাকশন কোম্পানির সাথে জার্মান প্রডাকশন কোম্পানির সহাবস্থানে যুগ্মভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ এসবই জার্মানি চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রা।

একটা সময় যে আমেরিকার হলিউড একচেটিয়া দখল করে নিয়েছিল জার্মানির চলচ্চিত্রের বাজার সেখানে বর্তমান জার্মানির চলচ্চিত্রকাররা আমেরিকান টিভি এবং প্রডাকশনগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, উপস্থিতি ঘোষণা করছে বিশ্ববাজারে। বিয়ন্ড সাইলেন্স চলচ্চিত্রের অস্কারে মনোনীত হওয়া বোঝায় জার্মান চলচ্চিত্রের কর্মপরিধি নীরবতার অন্তরালে কিন্তু প্রকাশমান প্রকাশ্যে, জগৎসভার আনন্দযজ্ঞে।
আরও দেখুনঃ